Wednesday, November 13, 2013

দক্ষিনাবর্ত – উটি পর্ব


স্মৃতি ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে এবং বিশ্বাসঘাতক। যখন যেটা মনে পড়ার কথা, সেইটা ছাড়া দুনিয়ার সমস্ত কিছু মনে পড়তে থাকে। এই যে লিখতে বসে প্রথমেই মনে করতে চেষ্টা করছি, ঠিক কোন বছরে আর কোন সময়টায় এই কলকাতা থেকে দক্ষিনমুখো সফরে বেরিয়েছিলাম, সেইটা কিছুতেই মনে পড়ছেনা। পরে, মনকে এই বলে প্রবোধ দিলাম, আমি যখনই যাইনা কেন, দক্ষিন তো দক্ষিনেই আছে। সেই যে তিনটে ঋতু, যাকে সায়েবরা বলতো – “হট”, “হ্টার” এবং “হটেস্ট”, তারও বদল হয়নি। হা-হতস্মী, সে সায়েবও গেছে, সে ইংরেজিও গেছে। এখন শুনি “হট” কথাটার মানে নাকি অন্য। কোন জায়গা সম্পর্কে “ইটস্‌ হট” বলার মানে... যাকগে, সে তো আপনি জানেনই। তার চেয়ে বরং আমার বেড়ানোর কথা কই। সময়টা কলকাতা আর ক্যালেন্ডারের হিসেবে শীতকালই ছিল বটে, সালটা বোধহয় ২০০৫ ই হবে। আমরা, মানে পরিবারের লোক জন আর বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন মিলে যথা সময়ে হাওড়া স্টেশনে করমন্ডল এক্সপ্রেসে উঠে বসলাম বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে। আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠা আমার কন্যা, সবে দু বছর বয়স, আর সর্বজ্যেষ্ঠ আমার পিতৃদেব, ৬৫। যথা সময়ে চেন্নাই পৌঁছেও গেলাম । নেমে দেখি, বেশ ফুরফুরে আবহাওয়া, যেমনটা আশা করে এসেছি, একেবারেই তেমনটা নয়। বরং মেজাজ গুমোট হলো তামিলনাড়ু ট্যুরিজমের হোটেলে ঢুকে। কেমন যেন মৃয়মান সবকিছু। প্লাস্টার খুলে আসছে। সর্বত্র একটা অজত্নের ছাপ। কিন্তু সে গুমোট কাটিয়ে দিলো রিসেপশানের সদাহাস্যময়ী কৃষ্ণকলি। তার চুলে লাগানো যুঁই ফুলের আর মাথার তেলের ভুরভুরে সুবাসে আর “হট কাপি” র প্রতিশ্রূতিতে।
চেন্নাইতে গিয়ে আর পাঁচজন যা করে, মানে সেই মারিনা বিচে ঢূঁ মারা, সেখানে ইডলি - ধোসার দোকান, বেলুনওয়ালা, ভেঁপুওয়ালা সমেত সবই দেখা হলো আমাদের। আমার পুত্র তখন দশ বছরের। তাকে নিয়ে গেলাম ফোর্ট সেন্ট জর্জ। সেখানে বিশালাকৃতির কামানের পাশে আমার ছোট্ট শ্রীমানের ছবি আজও রয়েছে। তবে কিনা, বাকি সব দেখার পর দলের মেয়েরা, পুরুষ আর বাচ্ছাদের হোটেলে মালপত্রের সঙ্গে নামিয়ে রেখে মোক্ষ দর্শনে বেরোলাম। নাল্লি, কুমারন, পোতিস, বিখ্যাত সব শাড়ির দোকা্‌ শিহরন জাগানো সব নাম। মালপত্রের কলেবর স্বাভাবিক ভাবেই বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেলো।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা আমরা চড়ে বসলাম নীলগিরি এক্সপ্রেসে। আমরা চলেছি মেত্তুপালায়ম। এ জায়গাটার নাম হয়তো একটু অচেনা। আসলে মেত্তুপালয়ম হলো উটকামন্ডের প্রবেশদ্বার। উটকামন্ড? আরে বাবা উটি। এবারে নিশ্চিত বুঝেছেন। ভোরবেলার মেত্তুপালায়ম রেল স্টেশন অনেক দিন মনে থাকবে। হালকা কুয়াসা, গা শিরশিরে ঠান্ডা, নীলচে পাহাড়, জীবনযাত্রার অলস গতি, স্টীম ইঞ্জিন এর ধোঁওয়া ওড়ানো রোমম্যানটিসিসম আর কফির গন্ধে সে যেন আমাদের এই চেনা দুনিয়ার অনেকটা বাইরের কিছু।
প্রথম দর্শনেই উটির প্রেমে পড়লাম। ব্রিটিশদের হাতে তৈরি আর পাঁচটা শৈল শহরের মতই, কিন্তু ভারি ভালো লাগলো, এ শহর তার নিজস্বতা বজায় রাখতে পেরেছে। শুধুই ব্রিটিশের হাতে গড়া সাজানো খেলনা হয়ে থাকেনি। মনে আছে উটির বোটানিকাল গার্ডেন, উটি লেক আর দোদ্দাবেতা পর্বতের চুড়া। এই চুড়া নীলগিরির চূড়া গুলির মধ্যে অন্যতম। এখান থেকে দূরবিন দিয়ে চার     পাশের ১৮০ ডিগ্রি নীলগিরি পাহাড়ের শ্রেনীগুলো দেখা যায়। আর একটু নীচে তাকালেই যত দূর চোখ যায় মন ভালো করা সবুজের ঢেউ। নানান শেড এর সবুজ – কচি কলাপাতা সবুজ, বোতলের সবুজ রঙের সবুজ আবার কোথাও শ্যাওলা সবুজ। স্বাভাবিক ভাবেই জানতে ইচ্ছে করে, যে এই সবুজে সবুজ পাহাড় কে নীলগিরি বলে ডাকা হয় কেন? তামিলনাড়ু ট্যুরিজ্‌ম এর হোটেল তামিলনাড়ু-১ এর ম্যানেজার বাবু আমার খটকার উত্তর দিলেন। জানলাম, প্রতি ১২ বছরে এই নীলগিরি পাহাড়ে নিলাকুরুঞ্জি ফুল ফোটে। তখন, সেই নীল এর ঢেউ কে সামলাতে পারেনা এই সবুজ পাহাড়। সেই নীল পাহাড়ের আকর্ষণে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। এই খটকা টা তো গেল, তবে আর একটা এসে তার জায়গা নিল... অপরূপ সুন্দর একটা জায়গা...ততটাই সুন্দর এই পাহাড়-চূড়ার হোটেল, নামকরনের সময়, তামিলনাড়ু ছাড়া আর কোন নাম কারো মনে এল না কেন? এর সদুত্তর অবশ্য ম্যানেজার সাহেব দিতে পারেননি...তার বদলে দক্ষিনি কায়দায় মাথা দুলিয়ে আমায় একটা আকর্ণ বিস্তৃত ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসি উপহার দিলেন।
তবে কিনা, এসব ছাড়াও আমার আকর্ষন ছিল আরো এক জায়গায়। সেই ব্রিটিশ জমানার চেল্লারামের দোকান। এখানে জুতোসেলাই থেকে চণ্ডিপাঠের যাবতীয় বস্তু পাওয়া যায়। কিন্তু তা ছাড়াও উটিতে আরো যা যা পাওয়া যায়, তা একসঙ্গে বোধহয় অন্য কোথাও পাওয়া মুশকিল। যেমন ধরুন ইউক্যালিপ্টাস, লবঙ্গ বা এলাচের তেল, ঘরে তৈরি স্থানীয় চকোলেট, গোলমরিচ, আরো নানান ধরনের মশলা, যা এই নীলগিরির আনাচে কানাচে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। যে কোনও বাঙালি মেয়ের, না না...ভুল বলা হল, পৃথিবীর যে কোনও কোনের যে কোন মেয়ের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লালিত প্রতিভা, ঠিক মুল্যে, ঠিক জিনিসটা কেনাকাটা করার অসীম ক্ষমতা তাদের, এটা করতে পারার যে স্বর্গীয় সুখ, তার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারলাম না এই দোকানে এসে..ব্যাগ এর চেন এর ওপর চাপ বাড়ল আর একটু।
উটি যদি তার ব্রিটিশ শৌখিনতার ধারা বহন করে থাকে, তাহলে তার সবচেয়ে বেশি প্রকাশ তার জিভে জল আনা কনফেকশনারি আর  বেকারির রকমারি তে,  আর  কেউ যদি ব্রিটিশ উন্নাসিকতার আভাস পেতে চান তাহলে উটি লেক এর আশেপাশে আগের প্রজন্মের দাদু দিদা দের পাক্কা ব্রিটিশ সাজপোশাকে সান্ধ্যভ্রমনে, অথবা উটির ক্লাব কালচারে টী-কোসি তে ঢাকা টী-পটরে, সান্ধ্যকালিন হাই –টী তে পরসেলেনের কাপ এ রূপোর চামচের টুং টাং এ  অথবা বহু–হোলড গলফ–কোরস এ ছুটির দিনের ভিড়ে সেটা প্রকট।
কুন্নুরের রাস্তায় দুদিকে ঢেউ খেলানো চা বাগান, আর মনে আছে এই কুন্নুরের রাস্তাতেই আমি জীবনের সবচেয়ে সুস্বাদু আনারস খেয়েছিলাম। সেই আনারসের চাকতি তে দক্ষিনি শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো মাখানো...চূড়ান্তও ঝাল আর তুমুল মিষ্টির সেই কম্বিনেশান আমার রসনার স্মৃতি তে আজও অমলিন। এখানেই সিম পার্কে দেখেছিলাম প্রচুর রুদ্রাক্ষের গাছ। সেই  দেখে আমার মা আর পিসীর উল্লাস ফ্রেম বদ্ধ করার মত। আমার দুই বছরের কন্যার মত ছুটোছুটি করে তারা রুদ্রাক্ষ ফল কুড়িয়ে কুড়িয়ে কোঁচড় ভরতি করল। ঘরের বেষ্টনীর বাইরে বেরোতেই কত ছোট খুশি যে আমাদের মন ছুঁয়ে যায়...
উটি থেকে ১৯ কিমি. দূরে, পাইকারা নদী কে বেঁধে ফেলার একটা চেষ্টা হয়েছে। সাথে একটি জল-বিদ্যুত প্রকল্প, মানব সভ্যতার উন্নতির পথে আর একটা ধাপ। আশেপাশের সবুজ বন, ধাপে ধাপে নেমে আসা নদীর সফেন জল, জলের নিচে চিক চিক করা মাছের আনাগোনা, দূরে সবুজ পাহাড়ের পিছনে কালো আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড, সব যেন ঠোঁট ফুলিয়ে নালিশ জানাচ্ছিল আমাকে।
উটি মুগ্ধ করেছে আমায়। সত্যি বলতে কি, নেহা্ত বেরসিক না হলে, কারোর পক্ষে উটির অমোঘ মায়াবী আকর্ষন কাটানো কোন মতেই সম্ভব নয়।

ডেস্টিনেশন কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ তেমন নেই। গন্তব্য শব্দটা তেমন চলে না। কিন্তু উর্দুতে ভারি সুন্দর একটা কথা আছে।আমাদের পরের “মন্‌জিল্‌” (মঞ্জিল নয়, বাংলায় ওটার মানে অট্টালিকা) পালঘাট, কেরলের একটা ঘুম-জড়ানো মফস্বল শহর। তবে সে আর এক গল্প, অন্য এক বৃত্তান্ত।

কলমে ঃ জয়ীতা সেন রায়

No comments:

Post a Comment

Till Death Do Us Part

The faint glow of the setting sun glistened on the ripples of the Jhelum, as the ripples moves away one by one. The wind coming from the ...