Tuesday, April 29, 2014

একলা চলার বউনি



আমাদের ছোটবেলায়, খয়েরি রঙের চামড়ার স্যুটকেস, শতরঞ্চির বেডিং আর টিফিন ক্যারিয়ারে লুচি আলু চচ্চড়ি সমেত সদলবলে ট্রেনের কামরায় উঠে গুষ্টিসুখ অনুভব করা দিয়ে শুরু হতো আমাদের বেড়াতে যাওয়া। ভ্রমনের সঙ্গে গুষ্টিসুখ, এ যেন ইলিসের সঙ্গে সরষে বাটা। বিউলির ডালের সঙ্গে আলু-পোস্ত।

যত বড় হয়েছি, গুষ্টিসুখের ধরন বদলেছে। আগে আমি ছোট ছিলাম, এখন ছোটোরা আমাদের সঙ্গে থাকে। গুষ্টির মধ্যেও বিভিন্নতা...কখনো বন্ধু বান্ধব, কখনো আত্মীয়-স্বজন, হবি-গ্রুপ, আবার কখনো অফিস কলিগ।ট্রেনে উঠে হই হই করতে করতে খাওয়া, খাবারের মেনুতেও বৈচিত্র্য। লুচি আলু চচ্চড়ির জায়গাতে পরোটা চিকেন কষা, বিরিয়ানি, বাঙালি রসনার উপযোগী চিনা চাউ- চিলি অথবা মাঞ্চুরিয়ান চিকেন এসেছে। যেটা বদলায়নি, সেটা হল গুষ্টিসুখের অনুভুতি। নিচের বার্থে একসাথে গুটিশুটি হয়ে বসে, খবরের কাগজ পেতে কাগজের প্লেটে করে ভাগাভাগি করে খাওয়া, খাবারের স্বাদই অন্যরকম। নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দের স্বার্থে আমরা যে আপনি-কোপনির জীবন বেছে নিয়েছি, সেটার একঘেঁয়েমিটা কাটাতে আমাদের এই একসাথে বেড়াতে যাওয়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। একা একা ভবঘুরেবৃত্তি আমাদের দেশে বিশেষ দেখা যায় না। যদিও বা দেখা যায়, তারা সকলেই পুরুষ। মেয়েদের একলা ঘুরে বেড়ানোতে আমাদের দেশে বিস্তর বিধিনিষেধ। প্রাথমিক আপত্তিটা বাড়ি থেকেই ওঠে। উঠোন সমুদ্র যদি বা পেরোলেন, রাস্তাঘাটে একলা দেখলে আমাদের অগনিত বীরপুঙ্গবরা উৎসাহী হয়ে পড়েন বড্ড। এই প্রসঙ্গে একটা ছোটবেলার স্মৃতির কথা মনে পরে গেল। নাইন কি টেনে পড়ি, মা আমাদের তিন ভাইবোন কে নিয়ে ট্রেন এ চেপে বাবার কর্ম স্থল হায়দ্রাবাদে যাচ্ছেন। মা, ভয়ে আধখানা হয়ে আছেন এই চিন্তায় যে তিনটে 'ছোট বাচ্চা'-কে নিয়ে একজন একা মহিলা কি করে পৌঁছবে। তখন ট্রেন এ লেডি'স কামরা থাকত। ছটা বার্থ থাকত সেই কামরাতে, দরজা টেনে বন্ধ করে দিলে, একটা আলাদা ঘর যেন। সেই ছটার মধ্যে চারটে আমরা দখল করলাম। আমাদের হট্টগোল থামতে, অপর দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসৎ পেলাম। দেখলাম বাকি দুজন বার্থে আমাদের সহযাত্রী, দুই স্বেতাঙ্গিনি, প্রায় আমারই বয়সী। বিস্ময় আর অবিশ্বাসের ঘোর কাটল যখন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে, স্কুল শেষ করার পর দুই বিলিতি বান্ধবী 'ব্রেক ইয়ার' নিচ্ছে। নিজেদের রোজগারের জমানো টাকা নিয়ে, বিদেশ ভ্রমণে বেড়িয়েছে। মনে পরে গেলো আগের বছরের কথা, স্কুল থেকে শিক্ষিকাদের অভিভাবকতায় ক্লাসের সব ছাত্রীদের পুরী যাবার একটা সুযোগ এসেছিল। হাজার অনুনয় বিনয় করেও, নানান যুক্তি দেখিয়েও, মার অনুমতি আদায় করতে পারিনি। বাকি সব বন্ধুদের হই হই করতে করতে যাওয়া আর খুশি ঝলমলিয়ে ফিরে এসে আমাকে ব্রাত্য করে নিজেদের মধ্যে সুখস্মৃতির সেই রোমন্থন করার সেই ঘটনা আবার মনে তাজা হয়ে গিয়ে, আমার মনের প্রলেপ পরা জ্বালাটাকে উসকে দিল আবার।



রাতে ঘুমের আগে বেশ সজাগ ছিলাম। মালপত্র তেমন কিছু নেই যদিও। কিন্তু কখন ঘুমিয়েছি নিজেই জানি না। পরের দিন ঘুম ভাঙল গাড়ির একটা ব্রীজ পেরোবার শব্দে। বাইরে তাকিয়ে দেখি মহানন্দা পেরোচ্ছে। একটু পরে নিউ-জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে গাড়ি ঢুকলো। আমি যাব মালবাজার, হাসিমারা পেরিয়ে আলিপুরদুয়ার। কিন্তু শোনা গেলো হাসিমারার আগে একটা মালগাড়ি হাতিকে ধাক্কা মেরেছে। ফলে লাইনে গাড়ি চলাচল বন্ধ। আমি পড়লাম অথৈ জলে। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। খুব অল্প আলো ফুটছে। শিলিগুড়ি শহর এখনো ঘুমন্ত। ষ্টেশনের ঘুমও ভালো করে ভাঙেনি। দু'এক জন সহযাত্রি ভাসা ভাসা  পরামর্শ দিলেন, যে নিউ-জলপাইগুড়ি ষ্টেশন থেকে রিকশা বা অটো করে পুরোনো শিলিগুড়ি জংশন ষ্টেশনে গিয়ে মালবাজার পর্য্যন্ত প্যাসেঞ্জার গাড়ি ধরে নিতে। কিন্তু স্থির-নিশ্চিত করে কিছু ভাবতে পারছিলাম না। কিছুটা অসহায় লাগছে এটা বুঝতে পারছিলাম। সেই সঙ্গে বিরক্ত লাগছিল, প্রথম বার একলা ভ্রমনেই এই বিপত্তি হল।




আমার বাবা বহুকাল আগে শিলিগুড়িতে থাকতেন চাকরিসূত্রে। সে সময়ের কিছু স্থানীয় মানুষের সঙ্গে পরবর্তিকালে আমাদের যোগাযোগ রয়ে গেছে। নিউ-জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেরকম একজন মানুষের কথা মনে পড়ে গেল। গৌরিদা আর বুবুন বউদি। খুব যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ওঁদের সঙ্গে এমনটা নয়। পরিচিত, এইটুকু বলতে পারি। আমার ফোনে খুঁজেপেতে ওঁদের বাড়ির নম্বর পেলাম। এক মুহুর্তের দ্বিধা, এই ভোরবেলা ঘুম ভাঙাবো? তার পরে করেই ফেললাম ফোন। ওপাশে গৌরিদার গলা পেয়ে মুহুর্তের মধ্যে কিছুটা ভরসা ফিরলো। গৌরিদা চিনতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে বললেন ওঁর বাড়ি আশ্রম পাড়ায়। একটা অটো ধরে পৌঁছলাম ওঁদের বাড়ি। রাজকীয় খাতির পেলাম। চা-জলখাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়লাম। এদিকে গৌরিদা ততক্ষনে অনেক কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছেন, সেটা বুঝিনি। ঘুম থেকে উঠে শুনলাম আমার জন্যে মাল বাজার পৌঁছনোর একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছেন গৌরিদা। এখান থেকে একটা ট্রেকার ছাড়ে দুপুর বেলা। সেটায় আমার জন্যে জায়গা থাকবে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে মালবাজারে নামিয়ে দেবে। আর মাল বাজারে সরকারি রেস্টহাউসে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন গৌরিদার এক আত্মীয়। এ যেন আমার কাছে মেঘ না চাইতেই জল। কি বলে যে......




মালবাজারে সরকারি অতিথিশালা একটা বিশাল ব্যাপার। কিন্তু অতিথি খুবই কম। রিসেপশানে সরকারি কর্মচারী ভদ্রলোক রীতিমতো ধর্মসঙ্কটে পরে গেলেন। বৈধ সব কাগজ পত্র আমি জমা দিয়েছি, তবু বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন যে সাথে কোন অভিভাবক আছে কিনা। খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। ঘর পেলাম দোতলায়। জিনিষপত্র রেখে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসে এক কর্মচারির কেমন যেন মুখচেনা লাগলো। মনে পড়লো বাবার সঙ্গে বহু বছর আগে এসেও এঁকে দেখেছিলাম। উনি বললেন কোন চিন্তা নেই, যা লাগবে উনি ঘরে এনে দেবেন। শেষ বিকেলের আলোতে অতিথিশালার ছাদে উঠলাম। সামনে মাঠ, আমবাগান, বহুদুরে নীলচে পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে উত্তর দিকে। চারিদিক খুব নিস্তব্ধ। সন্ধে নেমেছে। অতিথিশালার বার থেকে কিছু হইচই ভেসে আসছে। একটু ভয় করছিল। নেমে এলাম নিচে। ঘরের দেওয়ালে হরেক বর্ণের মথ। নিজের সাথে আমি মুখোমুখি আজ বহুদিন পর। একদম একলা। কিন্তু সত্যি কি একা? বাড়ির লোকজন বা বন্ধুরা নেই বটে, কিন্তু আছেন গৌরিদা, ওঁর সেই নাম না জানা আত্মীয়, যিনি আমার থাকার বন্দোবস্ত করেছেন, আরো আছেন অতিথীশালার সেই বয়স্ক কর্মচারিটি। একলা কোথায় আমি? একা না বেরোলে এই মানুষগুলো অচেনা থেকে যেতেন হয়ত। একলা চলার বউনি করতে বেরিয়েছিলাম। নতুন বন্ধুত্ব আর সম্পর্কের বউনিটা হিসেবে ছিল না। অলমিতিবিস্তারেণঃ

কলমেঃ জয়ীতা সেন রায়

ছবি: লেখিকার নিজের

Till Death Do Us Part

The faint glow of the setting sun glistened on the ripples of the Jhelum, as the ripples moves away one by one. The wind coming from the ...