Friday, March 6, 2020

ছোট হাসি, ছোট ব্যাথা - ১

পালং শাক ও ব্রেনোলিয়া


জীবনে প্রথম বোর্ড পরীক্ষা তিন বার দিলাম। না না! সৎ পাত্রের দ্বিতীয় সংস্করণ ভেবে বসবেন না যেন। খাড়ান…বুঝিয়ে বলি। ১৯৮৭ সালে এক্কেবারে প্রথমটা। সেবার অনেকটা এর গুরুত্ব আর তাৎপর্য না বুঝেই দিয়ে ফেলেছিলাম। সেই সময় পরীক্ষার্থীর বাবা মা এর এমন পাগলপারা দশা হতে দেখতাম না। তবে এর ব্যাতিক্রম ও আছে, যার উল্লেখ সময় পেলে পরে করবখন। দ্বিতীয় বার দিলাম পুত্রের সঙ্গে, ২০১২ সালে। সে বার আশঙ্কা, উদ্বেগ, জোশ, সবই তুঙ্গে। রাত দিন এক করে ছেলের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছি । তখনো ওয়াটসঅ্যাপ এর পান্ডেমিক দ্বারা পৃথিবী আক্রান্ত হয়নি। উপদেষ্টা মণ্ডলী তখন মুঠোফোনেই যথেষ্ট সক্রিয়।

ওয়াকিবহাল মা এর দল, নিত্যনতুন গাইডলাইন প্রচার এবং রটনাতে ব্যাস্ত। আমাদের মত গুটি কয়েক মা, যারা বাচ্ছাদের গেটে ছেড়েই হন্টন দেয় বাড়ির দিকে, গোল  টেবিল সম্মেলনে যোগদান না করে, তারা তখন বাকি মা দের করুণাপ্রার্থী। 

বার বার তিনবার।কন্যার প্রথম বোর্ড পরীক্ষা শুরু হয়েছে।এবার উঠে পড়ে লেগেছি। যে সব কিছু প্রথমবার করা উচিত ছিল আমার, কিন্তু করিনি বলে পরে হাত কামড়েছি, সেই সমস্ত করিয়েই ছাড়ব। মেয়ের মধ্যে কোনও আশঙ্কা, উদ্বেগ অথবা সংশয় গোচরে আসছে না। আমি চেঁচামেচি করে ফেলছি, আমার সুকোমল প্রবৃত্তি গুলোতে কর্কশতা প্রকাশ পাচ্ছে, এই পরীক্ষার গুরুত্ব বোঝাবার চেষ্টা করছি আপ্রাণ। কন্যা হেলা ভরে তাকিয়ে বলে উঠছে “চিল মা, টেনশন নিও না” । সবাই বলে দিয়েছে এত বড় মেয়ে কে বেশি বকাঝকা করা চলবে না, মায় আমার বাবা পজ্জন্ত বুঝিয়েছে আমাকে, যে বেশি বকাঝকা করলে কোন কথা আবার মনে আঘাত দিতে পারে, (সেই বাবা, যে বাবা সন্তান শাসনের ক্ষেত্রে একমাত্র ধাঁইধপাধপ পদ্ধতিতেই আস্থা রাখতেন, বেশি কথা বলে শক্তিক্ষয় করাতে উনি বিশ্বাস করতেন না।) আমি দাঁত কিড়মিড়  করতে করতে স্বগোতক্তি করছি “তুমি সামান্য টেনশন নিলে তো আমাকে আর টেনশন করতে হত না বাছা”।

এই সময় গুলোতে সামান্য দার্শনিক ভাব দেখা দেয় আমার মনে। আমার মনে হয় যে আমরা একটা ‘স্যান্ডউয়িচ জেনারেশন’, আজ পর্যন্ত বাবা মা এর উপদেশে ঘাড় ডান দিকে কাত তো ছেলেমেয়ের নির্দেশে ঘাড় বাম কাঁধ ছোঁয় । আবার মূল বক্তব্য থেকে বিপথে যাচ্ছি,(বয়স যে হচ্চে তার লক্ষণ)। বয়স হবার আরো দুটো লক্ষণ প্রকট আমার মধ্যে, এক-পুরনো ছবি ঘাঁটা, দুই-পুরনো ঘটনার স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করা।

সেই সুত্র ধরেই মনে পড়ে যাচ্ছে আমার প্রথম বোর্ড এক্সাম এর সময়ের পরীক্ষার থেকেও ভীতিদায়ক কিছু স্মৃতিকথা।
আমরা, মানে আমি এবং আমার দুই ভাই চক্ষু মেলা ইস্তক দেখে আসছি যে আমাদের পরিবারে, হোমিও আর আয়ুর্বেদ এর ওপর অগাধ ভরসা। একদিন নিমপাতা কাঁচা চিবিয়ে খাওয়া, তো পরের দিন চিরতার জল লম্বা গেলাসে বরাদ্দ। উইকেন্ড হাইলাইট ও ছিল। হু হু। ছাড়াছাড়ি নেই কো। আমার ঠাকুরমা, যাকে দাদি বলে ডাকতাম, তিনি, কালমেঘ পাতা বেটে এমন সুচারু ভাবে বড়ি দিতেন রোদ্দুরে, যে সেটা প্রায় শিল্পের পর্যায় চলে গেছিলো। এই বড়িগুলো আমাদের রবিবার সকালে বরাদ্দ ছিল। এরকম অনেক অনেক উদাহরণ দিতে পারি আপনাদের, কিন্তু আপাতত ‘আই সি এস ই’ আমার প্রথম বোর্ড এর সময়ের গপ্পো। ক্লাস টেন এ উঠতেই আমার মা কার যেন পরামর্শে একদিন ‘ইউরেকা’ মার্কা হাসি নিয়ে একটা কালো বোতল এনে আমার বিছানার পাশে টেবিলে রাখলো। বোতলের গায়ে লেবেল সাঁটা, লেখা আছে ‘ব্রেনোলিয়া’। মা শুনে এসেছে যে এটা নিয়মিত সেবন করলে ‘মাথা খোলে’। শুরু হল সকাল রাতের অত্যাচার। বিশ্বাস করুন, মুখে রা কারিনি কখনো। সাহসই ছিল না। কেমন খেতে ছিল, সে নিয়ে আর নাই বা কিছু মন্তব্য করলাম।

পরীক্ষা আরো এগিয়ে এলো। আমাদের সময়ে দিনে দুটো করে দুই ঘণ্টার পেপার হত। প্রথম দিন ছিল ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পেপার, স্পষ্ট মনে আছে। আমাদের ছিল হোম সেন্টার। পেপার ওয়ান দিয়ে বেরিয়েছি, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে।গেট এর সামনে অনেক গুলি উদবিঘ্ন মুখের মধ্যে আমার মায়ের মুখটাও চোখে পড়ল। হাতে টিফিন বক্স, কাঁধে ফ্লাস্ক। গেট এর পাশে দারোয়ানের ঘরের সামনে এক চিলতে জায়গা তে পাম্প স্টোভের ওপরে ছোট কড়াতে তেল গরম করছেন এক কাকিমা(এক বন্ধুর মা), লুচি ভাজা হবে গরম গরম। আলুর দম সাথেই এনেছেন উনি। মার্চেন্ট অফ ভেনিসের মলাটের ব্যাসানিও, শাইলক, পরশিয়া, অবহেলিত হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। সব বন্ধুরা কাকিমা কে ঘিরে ধরেছে।গন্ধটা নাক অবধি পৌঁছনোর আগেই মা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসালো, প্রিন্সিপাল এর অফিসের সামনে চওড়া সিড়ির ধাপে। কয়েকজন বন্ধু গুটি গুটি পায়ে আমার টিফিন বক্সের দিকে। পর্দা উঠল, মানে, আমার টিফিন বক্সের ঢাকা খুলল। কয়েকজন ঝুঁকে পড়লো... ভিতরে পালং শাক সেদ্ধ, নুন গোলমরিচ ছড়ানো, অল্প মাখন দেওয়া, আর ছোট্ট একটা স্টীলের কৌটো তে একটা সন্দেশ। যাঃ এটা হতে পারে না, আরো টিফিন কৌটো আছে নিশ্চয়!... ফ্লাস্ক এর মুখ খুলে এক গ্লাস ‘ট্যাং’ অরেঞ্জ ড্রিঙ্ক, মা পরম মমতা ভরে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। চারপাশে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলাম, যেমন ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো ধরতে চায়, অনেকটা সেরকম। কিন্তু আশপাশ দেখলাম নিমেষে শুনশান। আমার ব্যাক্তিগত বিপর্যয়ে কেউ পাশে দাঁড়ায়নি আমার। শুধু সেদিন না, যে কদিন পরীক্ষা চলেছিল, একদিনের জন্যেও মেনু তে কোন বদল ঘটেনি মায়ের। সোনামুখ করে খেতে হয়েছে। পরবর্তী পেপার গুলো কে যত না ভয় পেয়েছি, বোধহয় তার চেয়ে বেশি ভয় পেতাম টিফিনের সময়টাকে।

পরিসমাপ্তিতে একটা কথা। আমার মায়ের আজো দৃঢ় বিশ্বাস যে আজ আমার আর ভাইয়ের যেটুকু ‘ব্রেনোচিত’ উন্নতি, সেটা শুধু ওই পালং শাক সেদ্ধ আর ব্রেনোলিয়ার গুনেই। একেবারেই অকাঠ্য যুক্তি, বিরোধিতা করার কোন জায়গাই নেই!

কলমে : জয়ীতা

Till Death Do Us Part

The faint glow of the setting sun glistened on the ripples of the Jhelum, as the ripples moves away one by one. The wind coming from the ...