Wednesday, March 16, 2016

এলোমেলো পি কিউ

চার পাঁচ বছর বয়সটার কথা অনেকের মনেই নেই, কারো কারো অল্পস্বল্প খেয়াল আছে। টুকরো স্মৃতি কিছু মনে আসে। এ, বি, সি, ডি গান গাইতে শিখেছি, এল, এম, এন, ও, পিঁ, কিউ কে আদো আদো গলায় গাইতাম, এলোমেলো পিঁ, কিউ। লাল নেট এর ফ্রক পরে প্যান্ডেল যাওয়া, হঠাৎ করে চোখের সামনে আসে, আরো আসে, দুর্গা পুজোর নবমীতে আমার গম্ভীর বাবার, হঠাৎ করে ধুনুচি নাচ। আমার ঠাকুমাকে দাদি বলতাম, ওনার হাত ধরে স্কুল থেকে ফেরার পথে হজমি কেনার বায়না, একই হজমিওয়ালার কাছে, স্পষ্ট মনে পড়ে। দাদির হাত ধরে, ইলোরা সিনেমা হল এ ‘জয় বাবা তারকনাথ’ দেখতে যাওয়ার কথাও নিতান্তই ছোট বয়সের অনেকগুলো ছেড়া ছেড়া ছবির মধ্যে একটা।

দশ বছর বয়স থেকে গোগ্রাসে, ‘এনিড ব্লাইটন’ পড়তাম। আমার সমসাময়িকদের অনেকেই ‘ফেমাস ফাইভ’ এর রোমহর্ষক কার্যকলাপ, আর ‘সিক্রেট সেভেন’ এর গোয়েন্দাগিরির কথা এখনো মনে করতে পারবে। যেমন পারবে, মনে করতে ‘সেন্ট ক্লেয়ার’ সিরিজের, ‘প্যাট আর ‘ইসাবেল’ এর স্কুল-হস্টেল জীবনের দুষ্টুমি, পড়াশোনা আর তার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাওয়ার কথা। এই বই গুলো তে, মাঝে মাঝেই পড়তাম, ‘mind your p’s and q’s’. মানে বুঝতে পারতাম না, পরে জেনেছি যে মোটের ওপর এর মানে হচ্ছে, শিষ্টাচার, ভব্যতা, নিয়ম বজায় রেখে চলা।

আমার ছোটবেলা যে বাড়িতে কেটেছে, সেই বাড়ির পলেস্তরা খসা দেওয়ালে, লোডশেডিংয়ে হ্যারিকেনের আলোর কাঁপা কাঁপা আলো-ছায়াতে দাদির গায়ের কাছে ঘন হয়ে বসে, গল্প শোনা যেন নিমেষে ছায়াছবির মত মূর্ত হয়ে উঠত। আমাদের বাড়ি যে ঘিঞ্জি ছিলো, তা নয়, কিন্তু আজকের নিরিখে অগোছালো ছিল তো বটেই। বারান্দায় দড়িতে গামছা ঝুলত, ঘরেতে, বিছানার চাদরের সঙ্গে মাথার বালিশ কি পাশবালিশের ওয়াড় মিলত না। সেই অগোছালোপনা কেমন একটা আপন আপন গন্ধ বয়ে আনত। বাড়ির সামনে উঠোনে অনেক আগাছার মধ্যে ছিলো, একটা আম, দুটো পেয়ারা, একটা গন্ধরাজ লেবু আর একটা দিশি আমড়া গাছ। পেয়ারা গাছে উঠেই পেয়ারা খেতাম, আর আমড়া তলাতে পাতাবিহীন ডালের তলায় ঘোরাঘুরি করতাম, কখন টুপ করে হলুদ, পাকা দিশি আমড়া পড়বে আর ফটাস করে ফেটে যাবে। দুপুরে তিন জন ভাই বোনের ভাত খাওয়া শেষ হলেই, সাদা এনামেল এর গামলাতে কাঁচালঙ্কা, নুন, চিনি আর কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে দাদি সেই আমড়া মাখত। ছড়িয়ে দিত অল্প ধনেপাতা। সেই স্বাদ, সেই গন্ধও, সেই আমড়া-মাখা খাওয়ার সময়ের অনুভূতির স্মৃতি, সেই সময় টাকে পার করে আসার, আর ফিরতে না পারার যে বাস্তব উপলব্ধি, মনের মধ্যে যে তোলপাড় টা ঘটায়, মনটাকে হু হু করায়, তাকে ঠিক কি যে বলে, জানিনা।
দুপুরে কালো এলুমিনিয়াম এর বাক্স মাথায় কেশরী যাদব কেক ফিরি করতো, বিচিত্র সুরে হেঁকে বলত ‘কেকওয়ালা’ কিন্তু শুনে মনে হত, বলছে, ‘ভীমপলা’। জানলার শিক ধরে বাঁদরের মত ঝুলতে ঝুলতে আমরা তিন ভাইবোন ‘ভীমপলা’ ‘ভীমপলা’ বলে চেঁচামেচি করেই আনন্দ পেতাম। মাসে হয়ত একদিন সেই ভীমপলাকে বাড়ি তে ডাকা হত, সবার ভাগে একটা গোটা কেক কি প্যাঁটি জুটত না, ভাগাভাগি করে খেতাম, যদিও তাতে আনন্দের মাত্রা এতটুকু কম লাগত না। তখন অবশ্যও, কেক আর প্যাটিস বলে জানতাম, পেস্ট্রি অথবা প্যাঁটি বলতে শিখিনি। লাল শালু তে বাঁধা বড় পেতলের হাড়িতে আসা কালো টিনের চোঙ্গাতে কুলফি মালাইতেও ছিল অবাধ আনন্দ। 
দুর্গা পুজোতে জনে জনে দাদি, বাবা, মা, বড়কাকু, কাকিমনি, ভালপিসি, বড়পিসির কাছ থেকে টাকা জড়ো করতাম। সর্বসাকুল্যে হয়ত তিরিশ কি চল্লিশ টাকা জুটত, তাতেই রাজা আমি। এর মধ্যে অর্ধেক টাকা খরচা হত ভাই যুগলের বন্দুকের ক্যাপ কিনতে, বাকিটা ঘুগনি আর আলুকাবলি খেতে। তখনো রোল এর চল অত হয়নি। বিজয়াতে পাড়ার সব বাড়িতে গিয়ে নারকোল নাড়ু আর বাড়িতে বানানো ঘুগনি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আর রেওয়াজ ছিল, সব গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা। পাড়ার বড়দের বড় বলেই জানতাম, মানতাম ও। পাড়ার নাম করা টেড়ি বাগানো সৌখিন দাদাদের ও দেখেছি, পাড়াতুতো কাকা কে দেখে সিগারেট লুকোতে। 
মার সাথে প্রথম ইংরেজি বই দেখতে যাওয়া হলো, গ্লোবে। তখন সিনেমাকে ‘বই’ বলা হত বাড়িতে। ‘টোয়েন্টি থাউসেন্ড লিগস আন্ডার দা সি’ চলছে, হলে। মনে হল যেন এই ক্যাপ্টেন নিমো যেন কত দিনের চেনা। একাত্ম হয়ে দেখেছি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। রাতে অন্ধকারের মধ্যে সিনেমার প্রতিটা ফ্রেমের শিহরন নতুন করে অনুভব করেছি। সেই দিনের সিনেমা হল এর গন্ধটা আজ ও পাই। “কি আনন্দ, কি আনন্দ, কি আনন্দ, দিবারাত্রি, নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ – সে তরঙ্গে, ছুটি রঙ্গে, পাছে পাছে…” 
আমার বাবার ছিলো বদলির চাকরি। বেড়ানো বলতে ছিলো, গরমে আর শীতকালে, বাবার কাছে বেড়াতে যাওয়া। স্কুল ছুটি পড়ার অনেক আগে থেকেই, সেই জায়গার কল্পনাতেই, আর অনুমানেই ভাই বোনেদের নির্মল হাস্যরসে আর আড্ডায় দুপুরগুলো সরগরম হয়ে উঠত। 
নিজের বলতে খুব কম জিনিস ছিল, বেশির ভাগ সার্বজনীন সম্পত্তি। জন্মদিনে, কখনো একটি বই অথবা কাঠের রংপেন্সিল এর সেট পেলে, সেটা স্বাভাবিক নিয়মেই তিন ভাই বোনের সম্পত্তি হয়ে যেত। একটা ছোট কাঠের দেরাজে দুটো তাক ছিলো, আমার আর ভাইয়ের, আলাদা কোন পড়ার ঘর অথবা পড়ার টেবিল ছিলোনা। দেরাজের দুটো তাক আমাদের দুজনের বই রাখার জায়গা ছিলো। ভাগ করে গুছিয়ে রাখতাম, বইখাতা, গল্পের বই, পুতুল, আরো সব নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ বহুমূল্য সম্পত্তি গুলো কে। ছেলেবেলার অনাবিল সারল্যের সাথে সেই ভাগাভাগির দিন শেষ। অথচ যখন ছিল, তার চেয়ে মহার্ঘ্য আর কিছু ছিল না। ২ টাকার ‘অমর চিত্র কথা’ ও খুব দামি ছিল, চাইলেই পেতাম না, বাবার কাছে রীতিমত দরবার করতে হত। মনে হত যে কবে বড় হবো, কবে নিজের ইচ্ছে তে একটার বেশি, আর একটা ‘অমর চিত্র কথা’ কিনতে পারব। তখন কি জানতাম যে ‘বড় হওয়া মানে, বড় বেরঙিন’? 
সুমনের “তোমাকে চাই” আমার কৈশোরের শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দিয়েছিলো সে সময়ে। বারান্দায় গ্রিলের জাফরির আলপনার মধ্যে আধশোয়া হয়ে, বুকের কাছে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ তখন ছিল আমার বিশুদ্ধ মনকেমনের বিলাসিতা। সেই বয়সটাই ছিল মনকেমনের বিলাসিতায় ভরা। আকাশ কালো করে এলে মনকেমন, ‘শিলকাটাও’ বলে ডাক শুনলে মনকেমন, ঠাকুরঘরে শঙ্খের আওয়াজে মনকেমন আবার ‘ওগো দুখজাগানিয়া’ শুনলেও মনকেমন। কত অল্পতে মন কেমন, কত স্বল্পতে ভালোলাগা। রাস্তায় কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ছেয়ে থাকলেও মনে ঘোর লাগতো। যেমন ঘোর লাগত নতুন বই এর গন্ধে। প্রথম বৃষ্টির ফোঁটার গন্ধে সুর আসত গলায়, আপনাআপনি…“আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে, আসবে যদি শূন্য হাতে, আমি তাইতে কি ভয় মানি, জানি বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি” 
প্রত্যেকটা স্মৃতি যেন এক একটা গন্ধ দিয়ে, এক একটা অনুভূতি দিয়ে চেনা যায়। “তোমার ঘরে বসত করে, কয়জনা, মন জানোনা”। সেই গন্ধ আমার শিশুকাল, কিশোরিবেলা, যৌবন কে একটা Time warp এ আটকে রেখেছে। সময় কোথায় আর প্রলেপ ফেলতে পারল, স্মৃতির সেই পুটুলি তে? সারল্যর মায়া টুকু কাটিয়ে উঠতে পারলাম কই? মনের ভিতরে বাজতে থাকে “ইয়ে দওলত ভি লে লো, ইয়ে শোহরত ভি লে লো…ভলে ছিন লো, মুঝসে মেরি জওয়ানি। মগর মুঝকো লউটা দো বচপন কা সাভন, ওহ কাগজ কি কশতি, ওহ বারিশ কা পানি…” 
আমার মেয়ের অনেকগুলো ক্রেয়ন এর বাক্স আছে, কোনও একটা ক্রেয়ন বাক্সের একটা ক্রেয়ন হারিয়ে ফেললে, সে নতুন একটা বাক্সের জন্যে বায়না করে। তারা অভাব কম দেখেছে, না-পাওয়ার মধ্যে যে অল্পে মানিয়ে নেওয়ার সহজাত বৃত্তি তৈরি হয়, অল্পে খুশি হওয়াতে যে বিশুদ্ধ আনন্দ আছে, তার থেকে তারা বঞ্চিত। আধুনিক প্রযুক্তিতে চলে, এমন বহু খেলনা আছে আমার ছেলে-মেয়ের। আইপড এ গান শোনে তারা, ল্যাপটপ এ সিনেমা দেখে, কিন্ডেল এ বই পড়ে, পিএসপি তে গেমস খেলে, দুই ভাইবোন পাশাপাশি বসে। বছরে দু-তিন বার বেড়াতে যায় তারা, এক আধ বার বিদেশেও গেছে, কিন্তু সেই একটা আস্ত সবুজ মাঠ কে নিজের বলে কল্পনা করে বুক ভর্তি করে আনন্দ ভরে নেওয়ার সাধ্যি তাদের নেই। আমার ছেলে মেয়ে প্রণাম করতে যাওয়াতে, আমার ছেলের এক বন্ধুর মা, আমাকে সাবধান করেছিলেন এই বলে, যে বেশি মাথা নোয়াতে শেখাই যদি সন্তান দের, তাহলে তাদের self esteem and confidence মার খাবে। 
সব পি কিউ গুলো যেন এই বয়সে এসে আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অথবা হয়তো, সব নিজের নিজের সঠিক জায়গাতেই আছে। ও এর পরে পিঁ, আর কিউ এর পরে আর। নতুন হাওয়ার ঝাপটা লেগেছে। গুছিয়ে নিতে হবে নিজেকেই। এরা এদের যুগে এদের মত করেই পিঁ, কিউ সামলে, দিব্যি এদের ছেলেবেলা আর কৈশোর কাটিয়ে দেবে।

Till Death Do Us Part

The faint glow of the setting sun glistened on the ripples of the Jhelum, as the ripples moves away one by one. The wind coming from the ...