Sunday, May 10, 2015

এক মা থেকে আর এক মা অবধি ...

মধ্যবয়স্কা ' হোম মেকার '... স্বচ্ছল... স্বামীর রোজগার মন্দ না ...বাড়িতে খান কয়েক কাজের লোক... সুতরাং কাজকর্ম খুব একটা করতে হয়না । ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, তারা দিব্যি নিজেদের সমস্ত রকমের দেখভাল করতে পারে। ফলেই হাতে অঢেল সময়। বাড়ির মানুষ জনের সামান্য তদারকি, মানে, 'এই, তোরা খেলি?' "রেডি হলি?' 'পড়তে বসলি?' অথবা রান্নার মাসি কে, কি কি রান্না হবে, মানে, চিংড়ি মাছ নারকেল সর্ষে বাটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে হবে, নাকি মালাইকারি হবে, এই ধরনের গুরুতর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে নির্দেশ দেওয়ার পরে, আর বিউটি পার্লর এ গিয়ে সাপ্তাহিক, (কারো কারো ক্ষেত্রে দৈনিক) ফেসিয়াল, পেডিকিওর মানিকিওর সেরে, ছেলে মেয়ের স্কুল কলেজ এর বন্ধু দের মা দের সাথে, শ্বশুর বাড়ির নিন্দা, আর সকালের হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকের পর্ব সাঙ্গ করে, বেশ,  কি করি, কি করি একটা ভাব আসে । এই সময়েই ' মিড লাইফ ক্রাইসিস ' এ পাওয়া আমার মত অনেক মহিলার মধ্যে সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ঘটে, অনেকটা ছাই চাপা আগুনের মত, ছাই এর তলায় ধিকি ধিকি জ্বলছিল, এখন ছাই সরে যাওয়াতে, আর মাঝ বয়সের হাওয়া লাগাতে, বেশ একটা গনগনে আঁচের আভাস পাওয়া যাচ্ছে । 

মানে ধরুন, ছেলেবেলা তে যাকে উত্তম মধ্যম দিয়েও পড়াশোনা করানো যায়নি, কোনরকমে টেনে টুনে পাশ টুকু করেছে, সেরকম মহিলা দেখবেন, আচমকা, নিজের বিদ্যে এবং ডিগ্রি বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন...কিছু কিছু ক্ষেত্রে, নতুন করে সঙ্গীত চর্চা, নৃত্য শিক্ষা, সালসা, হিপ হপ জাতীয়, অথবা, আধ্মাত্তিক চিন্তাভাবনা, চর্চা... তবে সে সব কিছু ছাপিয়ে, আজকাল যেটা কেউ বাদ দিচ্ছেন না, বলা ভালো , যে দুটো, নেশার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না, মধ্যবয়সী বাঙালি মহিলাকুল, সেটা হল লেখা, আর তার চেয়েও  ভয়ঙ্কর একটা মহামারি, যার নাম অনায়াসেই 'ফটোগ্রাফি এপিডেমিক' বলে দেওয়া যায়... বলা ই বাহুল্য আমি এই দুটো অসুখেই ভুগছি, যার ফলস্বরূপ, আপনারা, পাঠক কুল ও ভুগছেন। এই দুটির কার্যকারণ, সুবিধা অসুবিধা, ভালো মন্দ নিয়ে বেশ কয়েক টা পাতা ভরিয়ে ফেলা যায়, বিষয় টি কম লোভনীয় নয়, কিন্তু, সেই ফাঁদ এ পা দিলাম না। দিলাম না, আমার সাঙ্ঘাতিক মনোবল এর পরিচয় দেবার জন্যে না, বরং দিলাম না, একটা সম্পূর্ণ অন্য কথা লিখব ভেবেছি বলে, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ দের নিয়ে লিখব বলে, যাদের এই পৃথিবী তে আসা তে, আমার জীবন এমন ভাবে বদলেছে, যে আমি কখন আর আগের মত হতে পারিনি অথবা হতে চাইওনি। 

কোথায় যেন পড়েছিলাম, যে মানুষ জন্ম নেবার আগে নিজের পিতা আর মাতা কে বেছে নেয়। আমার মন এই শোনা কথা টা কে সত্যি বলে মানতে চায়, আর যখন সেটা উপলব্ধি করি, আমার দুই সন্তানের ওপর কৃতজ্ঞতায় আমার মন কানায় কানায় ভরে যায়, তারা একটি মা কে জন্ম দিয়েছে বলে।

প্রথম বার মা হবার অভিজ্ঞতার কথা খুব আবছায়া তে ঢাকা। সেবার, নতুন কিছুর আশঙ্কা আর নিজেকে নিয়ে ভয় টা বোধহয় মন কে খুব বেশি আছন্ন করে রেখেছিল...খুব স্পষ্ট করে সব মনে নেই, যেটা মনে পরে, যেটা থেকে গেছে, সেটা হল একটা মিষ্টি রেশ। বেশ মনে পরে, আনেস্থেসিয়ার ঘোর যখন সামান্য কাটল, ছুরির ফলার আঘাতের মত তীব্র একটা ব্যাথা, আর 'আমায় পেথিডিন দাও' বলে চিৎকারের মাঝখানে আমার সামনে আনা একটা কাপড়ে জড়ানো ছোট্ট নাক, গোল গোল দুটো চোখ এর অবাক শান্ত তাকানো আর ফর্সা একটা কপাল দেখে ওই একটা মুহূর্তেই আমার মনে হয়েছিলো, "এ, আমার? এত সুন্দর বাচ্চা আমি জীবনেও দেখিনি তো!!" একটি সন্তানের জন্মের সাথে সাথে জন্ম হল, এক মুগ্ধ মা এর।

বিছানার কোনে, দেওয়াল ঘেঁসে শুয়ে শুয়ে অবাক হয়ে নিজের হাত আর পা দেখত ঋক, মাড়ি বের করা হাসি শুধু, কান্না নেই,  বিরক্তি নেই,  আর তাই ঋক এর মা, ঋক কে ডাকতো 'আনন্দ ছেলে' বলে। এই শব্দ টা শুনেই, নাকি মা এর মুখ দেখে, আবার এক প্রস্থ হাসি ছেলের। যখন, ঋক এর গায়ের দুধ আর পাওডার মেশানো গন্ধ পেতাম অন্ধকার ঘরে, মনে হত এই গন্ধ টা যেন আমার কত দিনের চেনা...আস্তে আস্তে, স্নান করা, খাওয়া, গল্প বলা, গান গাওয়া, মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেরানো, পড়াশোনা করা, ফুচকা খাওয়া, মাঠে খেলতে যাওয়া, সিনেমা দেখতে যাওয়া, কারো বাড়ি তে বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে, ঋক হয়ে উঠল, তার মার একার জীবনের একমাত্র সঙ্গী। একটা মুহূর্তের জন্যেও ঋক কে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারতাম না আমি, ঋক এর মা।

জীবনের এই ধারাবাহিকতার মধ্যে আবার বদল এলো, ঋক পড়ে ক্লাস ৩ তে...ঋক এর ভাই/বোন আসছে। মনে পরে, ঋক এর পরীক্ষা চলছে তখন, দিন এসে গেলো, সন্ধ্যে বেলা নার্সিং হোমে ভর্তি হতেই হবে, আর পিছিয়ে দেওয়া যাবে না ওকে ছেড়ে যাবার সময়টা কে...ঋক এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছিল " মা, যেও না" আমিও ভয়ে আর আশঙ্কা তে কান্না লুকোতে পারছিলাম ত। শুধু একটাই চিন্তা মাথা তে ঘুরপাক খাচ্ছিল, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, এই ছোট্ট শিশু, কি ভাবে বড় হবে? কে বুঝবে, ওর কথা? যদি, কোনদিন আর না দেখতে পাই, আমার ঋক কে?

ভর্তি হলাম, একা শুয়ে আছি নার্সিং হোমে র বিছানা তে। শুধু ঋক এর কান্না আর আমার জামা আঁকড়ে থাকা টা মনে পড়ছিল। জোর করে ছাড়িয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম । একা লাগছিল খুব। মনে হচ্ছিলো, আমার আশেপাশে কেউ নেই। এমন সময় সিস্টার, এলেন, কয়েকটা যন্ত্রপাতি নিয়ে। আমার প্রেশার মেপে, অন্য একটা যন্ত্র নিয়ে আমার কানে লাগিয়ে দিলেন, বললেন, নিন বউদি, বাচ্চার 'হার্ট বিট' শুনুন। অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম, আর একটা প্রাণের আওয়াজ। এ যে আলাদা একটা প্রাণ, এবং আমার এত কাছে, সেটা এই প্রথম অনুভব করলাম। আবার মনে হল, আমি একা কোথায়?

পরের দিন সকালে, আবার সেই ঘোরের মধ্যে শুনলাম, "জয়ীতা, চোখ খোলো, দেখ কত সুন্দর মেয়ে হয়েছে তোমার" । নাহঃ আর ব্যাথা নেই, কষ্ট নেই, শুধু একটা প্রশান্তি... 

শুনলাম, একটি শিশুর তীব্র কান্নার আওয়াজ, তাকে কিছুতেই চুপ করানো যাচ্ছে না, পাশের ছোট্ট কট এ শুয়ে, সিস্টার এর কোলে শুয়েও তার কান্না আর বন্ধ হয় না। ব্যাথায় পাশ ফিরতে পারছি না, সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে, তবু মন টা ভিজে গেলো। ছোট্ট, শ্যামলা এক মাথা ভর্তি চুল অলা কপালে ধ্যাবড়া পাওডার এর টিপ পরা একটা শিশু কে দেখে বড্ড মায়া লাগল। আমার কোল এর পাশ টা তে চাইলাম মেয়ে কে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিস্টার আমার কোল এর কাছ টা তে এনে দিলো শিশু টি কে...এক নিমেষে, সব শান্ত । ও আমার গায়ের গন্ধে বোধহয় আমার মতই আশ্বস্ত হল। সেই সময় থেকে, আমার কোল এর পাশ ছেড়ে আর সরানো গেল না আমার হিয়া কে।  


আজ 'মাদার'স ডে' আন্তর্জাতিক মাতৃদিবসে এই লেখা টি, আমার ঋক আর হিয়ার উদ্দেশ্যে লেখা।  

22 comments:

  1. Hi Madam,
    Gone through the post 'one mother to another mother' (i am using a google translation as I dont read bengali) . My mother came to mind immediately and followed tears in my eyes.
    Cheers to all mothers and their love for us
    Thomas

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thomas, this post is a short writeup on my emotional journey, as I attained motherhood. Since this post is about mothers and a tribute to motherhood, I thought it would be appropriate that I write it in my mother tongue. Though, you could not follow, my post, nevertheless, you made a point to encourage me. Thank you for that, and hope to translate this piece for you, some day.

      Delete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. দারুন লেখা। পড়ে বেশ ভাল লাগ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আবার এসে পড়বেন, মন্তব্য করবেন, এই আশা রাখি। ধন্যবাদ আপনাকে।

      Delete
  4. এই গল্পটা অনেক মায়ের গল্প। কিন্তু এমন সুন্দর করে এখানে এটা লেখা হল এটা আর অনেকের না সব মায়েদের গল্প হয়ে গেল। এক কথায় অসাধারন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সব মায়েদের মনের কথা যদি বলতে পারি, তার থেকে বড় প্রাপ্তি কিছু নেই আর... অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  5. বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ও ভাষার সাবলীলতা দুই এ মিলে লেখাটিতে আলাদা মাত্রা এনেছে।মুগ্ধ হলাম আবার অনুপ্রানিত ও হলাম

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্লগ এ এসে মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমার সাহস বাড়িয়ে দিলেন, বাংলা লেখা তে আমি সাবলীল নই, তবু উৎসাহিত করলেন বাংলা তে লেখার জন্যে

      Delete
  6. লেখা টা খুব সুন্দর..আমাদের মাদারস্ ডে রোজ .

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে। যথার্থ বলেছেন, আমাদের মাদারস ডে, রোজ । দেরি করে উত্তর দিলাম, মার্জনা করবেন।

      Delete
  7. Besh sundor lekha. Pore bhaalo laaglo

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাদের উৎসাহ, আমাকে এগোতে সাহায্য করে। ব্লগ এ স্বাগত জানাই

      Delete
  8. লেখা টা পড়ে আমার মেয়ে যেদিন হল সেই দিনের ঘটনা স্পষ্ট মনে পরে গেল। কি সুন্দর লিখেছেন। একদম সহজ সরল ভাষায়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্লগ এ আপনাকে স্বাগত জানাই। সেই দিনের অনুভূতি সব মা দের ই এক। আমার উদ্দেশ্য ছিল নিজের সাথে সাথে, অন্য মা দের ও সেই বিশেষ দি্ন টার কথা মনে করিয়ে দেওয়া। আপনার মন্তব্যে দেখছি যে আমি কিছুটা হলেও সফল। এটাই আমার পাওনা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

      Delete
  9. খুব সুন্দর লেখা। সত্যি মা হবার মুহূর্ত ভাষায়্ প্রকাশ করা সম্ভব নয় । এই লেখাটি আমাকে মনে করিয়ে দিল আমার মেয়ের কথা, আরো একবার।

    ReplyDelete
  10. khub e sundar lekha...Maa hober onubhutita bodhoi sob maa er jonnoi soman....tai lekhatir sathe khub ekatto bod korlam... dhonnobad

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি একমত। মা হবার অনুভূতি আলাদা হতেই পারে না। স্বাগত আপনাকে, এই ব্লগ এ। ধন্যবাদ।

      Delete
  11. মাদারস ডে'র দিন মাকে বেগুনি আর আলুর চপ কিনে এনে দেওয়ার পর মায়ের মুখের হাসিতে যে অনাবিল আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম, লেখাটা পড়ার পর মায়ের মুখের সেই অনুভুতিটা আবার চোখের সামনে ফুটে উঠলো!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার মন্তব্যে যে প্রাপ্তি টা হল, সেটা অতুলনীয়ও। আমিও মা, আমি জানি আমার ছেলে মাদারস ডে তে এরকম বেগুনি, আলুর চপ, এনে দিলে, আমার কেমন লাগবে...

      Delete

Till Death Do Us Part

The faint glow of the setting sun glistened on the ripples of the Jhelum, as the ripples moves away one by one. The wind coming from the ...