Sunday, October 22, 2017

অনুগল্প - দিনান্তে

সেজকাকিমা ব্রেস্ট-ক্যান্সারে মারা যাবার পর সেজকাকার আমাদের বাড়িতে যাতায়াতটা বেড়ে গেল। এই স্বজনহীন, বস্তুবহুল  একাকিত্বের বিষণ্ণতা ভরা শহরে, কাকার, আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন আত্মীয় ছিল না। কাকার একমাত্র ছেলে, শিবপুর থেকে পাশ করা, বাপাইদা, চাকরি, সংসার সামলে, খড়গপুর থেকে আসার সময় পেত না। হাওড়ার রামরাজাতলাতে কাকার বাড়ি যেদিন যেতাম, সেদিন কাকার অকারন ব্যাস্ততা আর চকচকে চোখ দেখে আমার মনে হত যে পরের বার আর এত দেরি করব না, তাড়াতাড়ি আসব।

কর্কট রোগ কাকার পিছু ছাড়ল না। মুখের ভিতরে, ঘা ছড়িয়ে পরল।  ক্রমশ জল টুকু গিলতে কষ্ট হত কাকার। শুনলাম যে বাপাইদার কাজের চাপ বেড়েছে, আসতে পারছে না। পরিসমাপ্তির খবর পেয়ে ছুটলাম। পাড়াপ্রতিবেশি একদুজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরে। কাকা ঘুমিয়ে আছেন পরমশান্তিতে। বাপাইদা সপরিবারে ঢুকল একটু পরেই। তোষকের তলার নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আলমারির চাবি বের করে আগে লকার খুলল। কয়েকটি গার্ডার-বাঁধা, চিরকুট-লাগানো নোটের বাণ্ডিল বেরোল। একটাতে লেখা ‘মাসকাবারি’, দ্বিতীয়টাতে ‘শেষযাত্রা’। সেই বাণ্ডিল খরচ করেই কাকার সৎকার হল। 


লেখিকাঃ জয়ীতা সেন রায়

তুর্কি বৃত্তান্ত

নাকউঁচু ইংরেজদেরও  রসবোধ প্রকাশ পায় মাঝে মাঝে। ইংরেজি বাগধারা তে ‘কিকিং দা বাকেট’, বলে একটা কথা আছে।  সোজা বাংলাতে এর মানে দাঁড়ায়, ‘পটল তোলা’। বোধহয় গলায় দড়ি দেবার সময়, বালতির ওপরে দাঁড়িয়ে, বালতি কে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া থেকে এর উৎপত্তি। আবার ‘বাকেট লিস্ট’ কথাটার উৎস, এই ‘কিকিং দা বাকেট’ কথাটা থেকে‘ বাকেট লিস্ট” অর্থাৎ শেষ ইচ্ছের ফিরিস্তি। পাঠক দের এই ফিরিস্তির মধ্যে চরকিপাক খাওয়ালাম এটা বোঝাতে যে, তুরস্ক  ভ্রমন আমার ‘বাকেট লিস্ট’ এ ছিল, বহুদিন যাবত।  

তুরস্ক, কেন? প্যারি, লন্ডন, জুরিক, রোম, কেন নয়? এর কারন তিনটেএক : ওসমানি সুলতানেরা এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপে @দাপিয়ে রাজত্ব করেছেন যে যে প্রদেশ তারা একে একে জয় করেছেন,  সেখান সেখান থেকে, তারা সেই  প্রদেশের সেরাটি তুলে এনে তাদের রাজধানি ইস্তানবুল কে সাজিয়েছেন তাই তুরস্ক আজ অনেকগুলি সভ্যতার উৎকর্ষের ধনে সমৃদ্ধ চারুকলা, স্থাপত্য, বিজ্ঞানে, খাদ্যদ্রব্যে, দৈহিক বৈশিষ্ঠে  এই তিন মহাদেশের সংমিশ্রণ চোখে পরে। প্রানবন্ত এই মিশ্রণের সংস্কৃতি কে চাক্ষুষ করার সাধ আমার বহুদিনের।(প্রসঙ্গত বলে রাখি, সামন্ততান্ত্রিক প্রথা ছাড়া এত বড় সাম্রাজ্য কে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারতেন না ওসমানী সুলতানেরা তাই সাম্রাজ্যটাকে বিভিন্ন প্রদেশে তারা ভাগ করে দিয়েছিলেন এই প্রদেশগুলি কে তারাবেয়িবলতেন

দুইঃ  পুরোদস্তুর ইউরোপে পা না দিয়েও, ইউরোপের স্বাদ পাবার সুযোগ।

তিনঃ লোকুম আর কেবাপ ইংরেজরা, যেখানেই পা দিয়েছে, নিজেদের সুবিধামত, দেশীয় শব্দের অদল বদল করেছে। এর কারন, পৃথিবীর বহু দেশে উপনিবেশ গড়ে তলার সুবাদে, ইংরেজরা তাদের নিজেদের দেওয়া নাম ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আজ তাই লকুম, সারা বিশ্বে পরিচিত আর আদ্রিত, ‘টার্কিশ ডিলাইট’ নামে। যেমন, তারা, তুরস্ক কে টার্কি বলে চালিয়েছে আর তুর্কির মহান ওসমানী সাম্রাজ্য কে সমগ্র পৃথিবীর কাছে পরিচিত করেছে ‘অটোম্যান এম্পায়ার’ নামে। এতে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে, নাকি প্রকাশ পেয়েছে তাদের ফক্কিকারির অহংকার, পাঠকরা ভালো বলতে পারবেন।

লোকুম এর সাথে প্রথম মোলাকাত ইস্তানবুলের রিচমন্ড হোটেলের প্রাতরাশ এর টেবিল এ। উত্তর ভারতে গেলে, একরকম মিষ্টি দেখতে পাওয়া যায়, নাম সোহন হালুয়া। ইস্তানবুলের হোটেলে্র রেস্তরাঁ তে দেখলাম, রংবেরঙ্গের চটচটে একটা মিষ্টি কিউব এর আকারে কাটা, দেখতে আর খেতে সোহন হালুয়ার মত, পাশে লেখা আছে লোকুম এই সেই ভুবন বিখ্যাত ‘টার্কিশ ডিলাইট’? দমে গেলাম খুবঅনেক প্রশংসা শুনেছি এই লকুমেরশেষে এই? হোটেলের এক বেয়ারা (অনেকটা অর্জুন কাপুরের মতন দেখতে) আমার মুখ ভেচকানো দেখে বোধহয় কিছু আঁচ করে থাকবে, আমাদের টেবিলে এসে মুখ নামিয়ে, ফিশ ফিশ করে বলল, আসল লোকুম চাখতে হলে আমরা যেন গ্র্যান্ড বাজার যাই। কথা উঠলো তাই বলে রাখা ভালো, ইস্তানবুলে যেদিকেই ঘাড় ঘোরাবেন, মুঠো মুঠো সঈফ আলি খান, রনবীর কাপুর, শাহরুখ খান, আমীর খান, আর শয়ে শয়ে, দীপিকা পাড়ুকোন, করিনা কাপুর, ক্যাটরিনা কাইফ, আর বিস্তর মধুবালা, ওয়াহীদা রহমান, বৈজয়ন্তীমালা বালী, শশী কাপুর চোখে পড়বে।  

গেলাম গ্র্যান্ড বাজারে, ওমা! এতো অবিকল আমাদের কলকাতার হগ মার্কেট। তফাত একটাই, কলকাতার নিউ/হগ মার্কেট এর বয়স ১৪৩ বছর , তবু তার ভাঙ্গাচোরা লড়ঝরে চেহারা, রক্ষনাবেক্ষনের অভাব প্রতিটি কোনায় স্পষ্ট। আর অপর দিকে, ১৪৫৫ সালে তৈরি ইস্তাবুলের গ্র্যান্ড বাজার দেখলে মনে হবে এই সেদিনে, বানানো। ঝকঝক করছে দোকানপাট, অলিগলি। যাকগে, তুলনায় গেলে মনখারাপ হয়ে যাবে, তার চেয়ে, লোকুম খুঁজি বরং। পর পর লোকুমের দোকান। সব দোকান থেকেই ঋষি কাপুর, শশী কাপুরেরা হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি জুড়েছে। একটা দোকানে তো হেমা, জয়া ও রাখি কে যেন গোল হয়ে বসে গল্প করতে দেখলাম। ঢুকে পরলাম একটি দোকানে, সঙ্গে সঙ্গে, প্লেট এ কয়েক রকমের লোকুম টুকরো এগিয়ে দেওয়া হল, ‘টেস্ট’ করার জন্যে। দেশে, আচার কিনতে গেলে যেমন আচার অল্প করে খেয়ে দেখে বাছতে বলে, সেরকমই। হোটেলের সেই ‘টার্কিশ ডিলাইট’ এর থেকে, রুপে,রঙে ,আকারে, স্বাদে, সব দিক থেকেই এই লোকুম আলাদা। কত রকমের যে লোকুম, আহা! চকলেট লোকুম, পেস্তা দেওয়া লোকুম, আপেল সাইডর লোকুম, সিনামন লোকুম, বাদামের লোকুম, অগুন্তি, অসংখ্য, বলে শেষ করা যাবেনা। ‘টেস্ট’ করতে করতেই ব্রাঞ্চ হয়ে গেল। ছয় মাস থাকে, নষ্ট হয়না...ইস্তানবুল ‘শপিং লিস্ট’ এ ‘মাস্ট’ এই দারুন ‘টেস্টি’ লোকুম

তুরস্কের রাজধানি আঙ্কারা, কিন্তু তুরস্ক ভ্রমন বলতে সবার ইস্তানবুলের নামই মনে আসে সবার আগে। ভুমধ্যসাগরের পারের শহর ইস্তানবুল, ফলের শহর, চোখ জুড়ানো ফুলের শহর, স্থাপত্যের শহর, ইতিহাসের শহর, কিন্তু আমি একে মনে রেখেছি, কেবাপের শহর হিসেবে। হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় কাবাব এই কেবাপ এর অপভ্রংশ। একটা লোহার শিকের ওপরে, মশলা মাখানো মাংস কে গেঁথে, আগুনের ওপরে ঝলসানো হয়। আসুন, তুর্কি কেবাপের সঙ্গে আপনাদের একটু আলাপ করাই।

শোনা যায় যে কেবাপের উৎপত্তি, পূর্ব তুরস্কের শহর, এরজুরুম থেকে। তুরস্কে মূলত ভেড়ার মাংস দিয়ে কেবাপ হত, অবশ্য, কেবাপে তুর্কিরা বেগুন আর টমেটো ও ব্যাবহার করে। আমিষাশী বন্ধুরা নাক না শিটকিয়ে, একবার খেয়ে দেখে রায় দেবেন। তবে গরু, মুরগি আর খাসিও চলে আজকালসুন্দরী আনাতোলিয়া প্রদেশের শহর, আদানা, তুরস্কে বিখ্যাত, শিষ কেবাপ আর আদানা কেবাপির জন্মস্থান হিসেবেলাল লঙ্কার অতিরিক্ত ব্যবহার এই আদানার কেবাপের বৈশিষ্ঠ। খেলে জিভে জল, চোখেও জল। বিখ্যাত, ডোনের কেবাপের জন্ম, ওসমানী সুলতানদের প্রথম রাজধানি, ‘বুরসা’ তে। যে ডোনের কেবাপের জন্যে আজকের তুরস্ক খ্যাত, তার জন্মদাতা, ইস্কেন্দর এফেন্দি। নমস্য ব্যাক্তি উনি। রসনার পথ ধরে, পৃথিবীর এত মানুষের মন কে বেঁধে ফেলতে পারা মোটেও সহজ কাজ নয়। ‘ইস্কেন্দর কেবাপি’ ‘বুরসা’ শহরের আর এক কেবাপরত্ন। বলাই বাহুল্য যে ইস্কেন্দর এফেন্দির নাম থেকেই এই কেবাপের নামকরন। খাদ্যরসিক ওসমানী সুলতানদের আর এক প্রিয় কেবাপ, ‘বেয়তি কেবাপ’। কেবাপের গপ্প শেষ হবার নয়। পাঠকরা আগ্রহী থাকলে, শুধু ইস্তানবুলি কেবাপের ওপরেই একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে ফেলতে পারি, কিন্তু আজ যে ইস্তাবুলের অন্তত কিছু বৈশিষ্ঠের কথা বলব বলে ভেবেছি, তাই প্রসঙ্গান্তরে চলে যেতে হচ্ছে।

মার্মারা উপসাগরের মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বিপের ওপর ভাসতে ভাসতে, টার্কিশ এয়ারওয়েস এর বিমান টুক করে ইস্তানবুল আতাতুর্ক হাভালিমানিতে নেমে পড়ল। হাভালিমানি মানে  তুর্কিতে যে বিমানবন্দর, সেটা নিশ্চয় পাঠকরা বুঝে নিয়েছেন। পৌঁছলাম আমার স্বপ্নের ইস্তানবুলে, পামুকের ইস্তানবুল, আয়া সোফিয়া, দোলমাবাহচে, তোপকাপির ইস্তানবুল, আতাতুর্ক এর ইস্তানবুল, ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস এর ইস্তানবুল, একটা সময়, তিন মহাদেশ, এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকার ওপর ছড়ি ঘোরানো, ওসমানী সুলতানদের রাজধানী ইস্তানবুল।  আবার পেরা প্যালেস হোটেলের ইস্তানবুল, মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্কের বিপ্লব পরিকল্পনার আঁতুড়ঘর যে ‘পেরা প্যালেস’ মার্মারা উপসাগর ভূমধ্যসাগরেরই একটি অংশ, এবং এটি পৃথিবীর একমাত্র উপসাগর যার সমগ্র তটরেখা জুড়ে কেবল একটিমাত্র দেশ, তুরস্ক। সেই মার্মারা উপসাগর থেকে, বসফরাস প্রণালী ইস্তানবুলের বুক চিরে, নিজে গিয়ে মিশেছে কৃষ্ণ সাগরের অর্থাৎ ‘ব্ল্যাক সি’ র জলে। কৃষ্ণ সাগরের তীর, চা বাগিচা আর ফলের বাগানের জন্য বিখ্যাত। অনেকেই খবর রাখেন না হয়ত, যে তুরস্কের চা পূর্ব ইউরোপে আর মধ্যপ্রাচ্যে বেশ খ্যাত। কারো বাড়িতে অতিথি হয়ে গেলে তো বটেই, এমনকি দোকানে সওদা করতে গেলেও প্রথমেই আপনাকে চা পানের আমন্ত্রন জানানো হবে। তুর্কিরা দুপুরের আর রাতের খাবারের পর ও কয়েক কাপ করে চা পান করেন।

ইস্তানবুলের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে এর একটা আভাস পাই।  এই শহরটি রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল সেই সময়ে। প্রথম আটশো বছর, রোমানরা পৌত্তলিক বা প্যাগান ছিলেন। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে, একটা পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। এই সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি বিশাল আকার ধারন করে। শাসনকার্যে অসুবিধার জন্য, ২৮৫ খ্রিস্টাব্দে, রোমান সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান, সাম্রাজ্য কে ইস্টার্ন এম্পায়ার অর্থাৎ পূর্ব সাম্রাজ্য ও ওয়েস্টের্ন এম্পায়ার অর্থাৎ পশ্চিম সাম্রাজ্যে বিভক্ত করেন। পশ্চিম অংশের রাজধানি হিসেবে, রোমে নগরী তার জায়গা বজায় রাখে। বর্তমান তুরস্কের বাইজান্টিয়াম প্রদেশ কে পূর্ব সাম্রাজ্যের রাজধানি বানানো হয়। তাই নব্য প্রতিষ্ঠিত এই পূর্ব সাম্রাজ্যটির নাম, রাজধানীর নামানুসারে ‘বাইজান্টাইন’, রাখা হয় সম্রাট কন্সটান্টাইন, ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে, বাইজান্টিয়াম এর অদুরেই একটি অধিক সুরক্ষিত স্থান নির্বাচন করেন এবং সেখানে একটি নগরী পত্তন করেন এবং তার নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে, নগরীর নাম দেন কনস্টান্টিনোপল। এই হল কনস্টান্টিনোপল এর শুরুর কথা। এরপর ধাপে ধাপে এই শহর, পরাক্রমশালী, হয়েছে, খ্যাতির চূড়া ছুঁয়েছে, অনেক সংঘর্ষ আর রক্তপাতের সাক্ষী থেকেছে, অনেক জাতির, অনেক ধর্মের, অনেক দেশের মানুষের মিলন হয়েছে এই শহরে। যেমন পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য, নানান আক্রমনে, তার আগের শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হতে থাকে, তেমনি আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে রোমান সাম্রাজ্যেরেই পূর্ব দিকটাও। ১৪৫৩ সালে, ওসমানী সুলতান, মুহম্মদ বিন ফতেহ, কনস্টান্টিনোপল দখল করে, এর নাম দেন, ইস্তানবুল। 

ইস্তানবুল আয়তনে যেমন বিশাল, তেমনি জমকালো তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, খাওয়াদাওয়া, মানুষজন, চমৎকার গানবাজনা, অতিথি আপ্যায়নের ধরন। লিখতে বসে, কত কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এই লেখার পরিধি সীমিত। তাই, চোখ বন্ধ করে ইস্তানবুল কে ভাবলে যে যে ছবি গুলো মূর্ত হয়ে ওঠে, সে টুকরো টুকরো স্মৃতি গুলোর কিছু নিয়েই লিখছি।

অনেকদিন আগে, ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে, তুর্কি নাচ দেখেছিলাম। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, যে, তুর্কি নাচ, যাকে আমরা ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহার করি, আসলে, উপাসনার একটি অঙ্গ। ঘুরে ঘুরে ঈশ্বরের মধ্যে মগ্ন হয়ে সমাধিস্ত হয়ে যান পীরেরা। এই নাচ কোনোদিন সামনে থেকে দেখব, এই ইচ্ছে হয়েছিলমৌলানা জেলালুদ্দিন রুমি (১২০৭-১২৭৩) দরবেশদের (বাঙালি মিষ্টি নয় কিন্তু, এখানে সুফি পীর দের কথা বলা হচ্ছে) প্রার্থনার একটি ধারা প্রবর্তন করেন। সুরেলা ধ্বনি আর স্তবের মধ্যে এই দরবেশরা মোহাবিষ্টের মত ঘুরে ঘুরে ঈশ্বর কে অনুভব করতে চান। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘সেমা’বৈষ্ণবদের ধর্মাচারের অঙ্গ, আখর দিয়ে কীর্তন গাওয়া আর নৃত্যের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর কে পাওয়ার চেষ্টার সাথে এই ‘সেমা’র একটা গভীর মিল পেলাম। শুধু তাত্বিক আদলে সদৃশ্যতা নয়, সব ধর্মের আত্মিকগত অভিন্নতা আরো একবার মনে অনুভব করলাম।  
ইস্তানবুলের এক পা ইউরোপে আর অন্য পা এশিয়াতে। মাঝে বসফরাস প্রণালির ‘টারকয়েস’ অর্থাৎ ফিরোজা রঙের জল। জানলাম যে ‘টারকয়েস’ শব্দটার উৎপত্তি, ‘টার্কি’ থেকে। এশিয়ার দিকটা নব্য, সাজানো, ছিমছাম। ইউরোপের দিক থেকে গাড়ি করে এসে, ওসমানী সুলতানদের, গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, ‘বেইলারবেয়ি প্যালেস’ দেখে মুগ্ধ হলাম। বসফরাসের তীরে প্রাসাদের অপূর্ব গোলাপ বাগান, শ্রীনগরের মুঘল গার্ডেন কে মনে করায়। ইউরোপের দিকে, ‘গোল্ডেন হর্ন’ বলে একটি খাঁড়ি পুরনো ইউরোপীও ইস্তাবুল আর নতুন ইউরোপীও ইস্তানবুল কে আলাদা করেছে।

পুরনো ইউরোপীয় ইস্তানবুলেই, বিখ্যাত সব স্থাপত্য, সুলতান আহমেত, যার অপর নাম ‘ব্লু মস্ক’, এছাড়া আয়া সোফিয়া, যেটি  বাইজান্টাইন আমলে একটি অপূর্ব ক্যাথিড্রাল ছিলো, পরে, ওসমানী সুলতানেরা আয়া সোফিয়া কে মসজিদ এ পরিবর্তন করেন। আতাতুর্ক, এর বিপ্লব এর পর আজ, এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য, একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত। দেখলাম, বিখ্যাত ‘তোপকাপি সারায়ি’ অথবা প্রাসাদ যেখানে, ৩২ জন ওসমানী সুলতান থেকেছেন এটি ১৪৭৮ থেকে ১৮৫৩ অবধি সুলতানের বাসস্থান এবং সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরে, ১৮৫৬ এ, সুলতান আব্দুল মেজিদ ১, দোলমাবালচে প্রাসাদে নিজেদের বাসস্থান স্থানান্তরিত করেন। দোলমাবালচে অনেকটাই ইউরোপিয়ান ধাঁচে গড়া। ফিরে আসি তোপকাপিতে। এই বিশাল প্রাসাদের রান্না ‘বাড়িটি’ ( ঘর শব্দ টা ব্যবহার করতে বাধলো ) দেখার মত। ফ্যাক্টরির চিমনির মত পাঁচটা চিমনি, এর মাথায়। এই রান্না বাড়ি থেকেই ‘পিলাফ’ ( যাকে আমরা পোলাউ বলি )  দোলমা ( যেটা মোটেও বাঙালি নয়, আদতে, তুর্কি ) বেরিয়েছে। দেখলাম ‘গালাতা টাওয়ার’এটি নজরমিনার হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর মাথা থেকে, ইস্তানবুলের ‘পাখির চোখের দৃশ্য’ দেখতে পাওয়া যায়। ‘গালাতা ব্রিজ’, ‘গোল্ডেন হর্ন খাড়ির ওপর, পুরনো ইউরোপীয় ইস্তানবুল আর নতুন ইউরোপীয় ইস্তানবুল কে যুক্ত করেছে। ‘গালাতা ব্রিজ’ এ অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে মাছ ধরছে। ব্রিজের নিচে রেস্তোরাঁ গুলোতে নানা  পদের মাছ রান্না করে বিক্রি হচ্ছে। ঘুরলাম ‘তাকসিম স্কোয়ার’ আর ‘ইস্তিকলাল কাদ্দেসিতে'‘ইস্তিকলাল কাদ্দেসি’ অর্থাৎ স্বাধীনতা রাজপথ, এক অভিনব রাস্তা। এই রাস্তায় কোন গাড়ি চলে না। দুই পাশে, হোটেল, জামাকাপড়ের দোকান, সুয়্যভেনিরের দোকান, খাবারের দোকান, রাস্তার পাশে ছেলে মেয়েরা বসে হাসছে, গান গাইছে, বাজনা বাজাচ্ছে, দোকানে দোকানে প্রবীণেরা গল্প করছে, টার্কির বিশেষ হাতল বিহীন কাপে চা খাচ্ছে, কেউ কেউ হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে, গন্তব্যহীন, উদ্দেশ্যহীন, উদ্বেগহীন। বড্ড ভালো লাগল এই উৎসব ছাড়াও উৎসবের মেজাজ, এদের উঁচু গলায় আড্ডা, এদের সামান্য ব্যাপারেই অট্টহাসি।

ইস্তানবুল থেকে নিয়ে যাচ্ছি ‘টার্কিশ তোয়ালে’ সিল্কের স্কার্ফ, লোকুম, টার্কির বিখ্যাত, আপেল-সিডার চা। আর নিয়ে যাচ্ছি, কামেরা-বন্দি অজস্র ছবি, স্মৃতি। কিন্তু এটাই কি সব? ওই যে তোপকাপি তে আলাপ হোল আধা তুর্কি, আধা জার্মান মেয়ে, তুগবা ডোগান এর সাথে, যে আমাকে তার বাড়িতে যেতে নেমন্তন্ন করল, আমাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলল, অথবা দোকানদার রেচেপ, যার দোকানে, কাপ প্লেট দরদাম করতে গিয়ে আধ ঘণ্টা ইন্ডিয়ার গল্প শোনাতে বাধ্য হলাম, আর গল্পের ফাঁকে খেলাম  তিন কাপ চা আর বাকলাভা। আরো কিছু মুখ, কিছু পরিচয়, হয়ত কিছু টান, কিছু সম্পর্ক থেকে গেলো, সেগুলো কি আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি না? গত তিন হাজার বছর, এই শহর দেখেছে নানান মানুষের আনাগোনা, গ্রীক, রোমান, আলবেনিয়ান, আরমেনিয়ান, বুলগেরিয়ান, আরব, রোমানিয়ান, আজারবাইজানি, আর কত দেশের লোক এসেছে, থেকেছে, কেউ গড়েছে, কেউ দখল করেছে, কেউ ধ্বংস করেছে, কেউ আবার মূলস্রোতে, মিশে গেছে । কিন্তু ইস্তানবুল আবহমানকাল ধরে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়ে রয়ে গেছে, রয়ে যাবে। আমি সঙ্গে নিয়ে চললাম একটুখানি ইস্তানবুল, আর হয়ত, ইস্তানবুল ও আমার মনের কিছুটা রেখে দিলো। প্লেন, মাটি ছাড়লো, ইস্তানবুল কে বললাম, “যাই”। ইস্তানবুল আমার কানের কাছে এসে বলে গেলো, “যাই বলতে নেই, বলো, আসি। আবার এসো কিন্তু”।


লেখিকা ঃ জয়ীতা সেন রায়

The Art Of Living

“We had to admit her, Ma”, Niladri’s nervousness was apparent in his voice over the phone. “But isn’t it three weeks too early?” I summoned enough courage to blurt that out. “Is she okay?” I asked, and it seemed rather foolish even to my ears. “She went into labour, ma. Initially we did not pay much attention to it, thinking of it as Braxton Hicks, but then the contractions came in faster and she is slated for an emergency caesarean section…do come down as fast as you can, ma. She needs you…” He trailed off. My mind was blurred. I felt numb. Was it too late? I wish I could turn back the clock and bring the wheels of time to a stop.

The world outside the window of the taxi was moving in its own pace. It was 10 AM in the morning and office goers were everywhere, on the pavements, in the buses and taxis. The roads seemed much more clogged than normal. “Jaldi chaliye, driver ji”…I kept asking the driver. As usual Jhinuk was in a hurry and the entire world seemed too busy. I tried to call Niladri, my son-in-law, but the call went unanswered. Perhaps he was in the Operation Theatre, assisting the Obstetrician, who, Jhinuk was seeing in her pregnancy. The taxi seemed to be moving at the pace of a snail.

“I have been looking for you everywhere, in the garden, up on the terrace, masi”, Dona my niece, quipped while tugging at my hands. “Come, see for yourself”, she urged me again. “I am sure that you must have done a fine job, Dona, I replied”, while trying to free my wrist from her grip. “I am yet to complete the arrangements for welcoming the groom, I am busy now, ‘babu’, now run along”, I chided her mildly. But Dona was insistent, “you are always busy, masi”. That sounded so much like Jhinuk. This was, what I had been all my life, busy.

Jhinuk was waiting in her room, with her friends, not demurely, as befitted a bride, but in her feisty, spirited self! She was talking excitedly with her friends and she slid down the settee as she saw me entering, and swirled around in her red Banarasi sari, her jasmine garland letting out a exhilarating scent, the intricate artistic designs on her forehead glistened in the arc-lights. “Am I looking, pretty, ma, Jhinuk asked”. You look distractingly beautiful, Jhinuk, I wanted to tell her, hug her and hold her, but a lump in my throat, and an unruly tear, made me just nod my head in appreciation and look away. She looked every bit, a Bengali bride. A ‘bride’ did I say? Did the years between, go by, that fast? “What was the hurry, Jhinuk?” I wanted to ask her. Just when I was consolidating my responsibilities, striving to lessen my work load and trying to give you more time at home, you found a new home for yourself.

“I would like you to meet, someone, ma” Jhinuk had softly mentioned to me, as both of us were getting ready to leave in the morning, she for her University classes and me for my office. Maybe, you did not want to break the news to me at leisure, so that it would not leave room for me to confront you with queries. That evening, I met Niladri, who was pursuing residency in gynaecology.  Here was somebody, who, after ages, was competing with me for your affections, Jhinuk. I spied on your diary later when you were away, shopping. I had to know your inner thoughts. A mother desperately trying to know her daughter through her diary posts. That was the distance that had grown between us slowly, but steadily. You had written, “Perhaps all beautiful relations grow slowly. Perhaps the most beautiful thing in life is to love and to be loved back in return.” The dried petals of the rose in your diary had been moistened with my tears.

Only the other, day, I was reading in the library, when I heard a sound, perhaps, your step on the floor and when I looked up, you were standing close to me. I remember the gleam of your sandals as you turned to make the dress, swirl around you.  You were going out with your college friends. It was the Ashtami of Durga Puja. I wished I had held you then and whispered in your ears, how each of my burdened days, after, your father’s demise, seemed lighter, when I saw your sleeping face when I came home from work. How, I felt alive, when you pattered up to me with your sleepy eyes in the morning and hugged me. How each of my steps weighed heavily when I reluctantly had to go to work despite your tears. But all these words seemed insufficient. I sat in silence, searching for a greater wisdom, and appropriate words till you grew impatient and said “But you do like my dress, Don’t you?” “Its nice”, I said. You were disappointed by the slightness of my comment. I remember the look of pain in your eyes and then you turned and said indignantly, “If baba were here, he would have surely said something better about my dress”.

Just a few more years back, you were going to your friend’s birthday party, and you had pleaded for a purple dress for the occasion to me in earnest. I remember your squeal of happiness at my acquiescent nod. I had foraged the market an entire hour during my lunch break, to find the perfect dress for you. When I was wrapping up my work for the day, I was asked to stay back a couple of hours. Tears were still dry on your cheeks, as you lay sleeping on your bed. A pale light from the moon, entered through the window panes, lighted up your face and bloodied my helpless soul. I wish I could turn back the clock and bring the wheels of time to a stop.

You were born at 4 in the morning. The nurse brought you in, and your baba and I took turns in holding you. You were beautiful. I was a vast sensation of loving my baby and wanting to see and hold you again and again. Even though I was very tired I did not want to sleep. I seemed to be surrounded by a glow and wonderful words seemed to be reverberating in my head. “Now you know why you are alive”, the words said. “You are alive so that you could receive this precious baby.” I kept praying. “Please make her good and let her grow up to be strong and understanding, so that she may feel, what I feel today, know what I know, and love a man as fine as my husband.” “Please God, hear my prayers.”

“Aapka nursing home, aa gaya hai, Maa ji”. The driver’s voice broke my trail of thoughts. Anxiously, I stepped out of the elevator. The corridor was empty and the lights were off outside the Operation Theatre, signifying that the surgical procedure was over. My legs started trembling at ominous thoughts. My fear was growing from inside out. I caught hold of the nearest chair and sat down in a stupor with my severely flawed motherhood. Perhaps it really was too late to vent my emotions to Jhinuk, to spell out to her, how much I really loved her and to let her know that living life in a linear progression had stripped me of my ability to express myself.

Niladri was beside me with an arm around my shoulder. “Let us go and meet both the girls, ma”. It took a while for his words to sink in. “Just close your eyes, unlock your dreams and then, look again”, he urged me, gently. Whatever had happened in this brief time in the outside world, did not seem to touch me anymore, as I followed Niladri with faltering steps.

Unabashed tears flowed over my granddaughter’s blanket, as I held her close to my heart, just the way, I had held Jhinuk, when she was given to me for the very first time. The aggregate of all my joys and sufferings seemed to culminate in that one bundle that I was holding. “I love you Jhinuk”. “I love you too, ma, and I am sorry” she replied as she hugged me. “You needn’t have said that, but somehow I am glad that you did.” I retorted mischievously. “And I do want to say that you look pretty, Jhinuk.”

Life is a search for balance and it perches itself delicately on the arms of time. And thus goes the world around, time in its season, grace in its moments of true knowing. The children become the mothers and the fathers and love begins again- at the beginning. I had led an extraordinary life in the cause of the ordinary and the wheels of the clock had stopped for me at a juncture, where I could start afresh.

Penned by: Jayeeta Sen Roy

Till Death Do Us Part

The faint glow of the setting sun glistened on the ripples of the Jhelum, as the ripples moves away one by one. The wind coming from the ...