Friday, February 21, 2020

ভাষা কে ভালোবেসে

                          ঘটনাক্রম-১                     

২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ সাল। কন্সটিটুশানাল আসেম্বলি অফ পাকিস্তান এর দ্বিতীয় অধিবেশন বসেছিল করাচীতে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই নিয়ে চলছিল জোর বিতর্ক । এখনকার বাংলাদেশ তখনো বাংলাদেশ হয়নি, ছিল পূর্ব পাকিস্তান। মহম্মদ আলি জিন্নাহ ছেয়েছিলেন যে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক, কারন, তার মতে, উপমহাদেশের মুসলমানদের দাবিতে মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান এর সৃষ্টি, এবং তাদের ভাষা উর্দু ফলেই, পাকিস্তানের ছয় কোটি নব্বই লক্ষ নাগরিকের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও, উর্দু পায় রাষ্ট্রভাষার তকমা, আর বাংলা কে সরকারি ভাষা হিসেবেও কোন স্বীকৃতি দেওয়া হয়না।  এই মর্মে ১১ই মার্চ ১৯৪৮ এ, বাঙালিদের আপত্তি এবং সোচ্চার প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই ভাষা বিল গৃহীত হয়। এর থেকে প জন্ম হয় বাঙ্গালীর জাত্যাভিমানের।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর সকাল। মায়ের ভাষার সন্মান রক্ষার্থে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধারা ১৪৪ অমান্য করে আন্দোলন শুরু করে।  ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর সামনে আন্দোলনকারী, সালাম, বরকত, শফিক, জব্ব্রর, রফিক, আরো কত নাম না জানা মায়ের ছেলেরা পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। এরপরে সাধারন মানুষ কে আর আটকে রাখা সম্ভব হয়নি, নানান নির্যাতন সহ্য করেও তারা বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় । ভাষা আন্দোলন এবার তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পরে। এই হত্যাকাণ্ড, মাতৃ ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে আরো ইন্ধন যোগায়।
অবশেষে ১৯৫৪ সালে ৭ই মে গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মাতৃ ভাষা নিয়ে এই আন্দোলনই সেদিন বীজ বপন করেছিল বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।

                           ঘটনাক্রম -২

১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন, ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেন। ১৮৭৪ সালে, ঠিক ৩৬ বছর পরেই, তাদের ভাগাভাগির খেলা শুরু হয়। তারা অভিভক্ত বাংলা কে ভাগ করে গোয়ালপাড়া আর শ্রীহট্ট এই দুই জেলা কে নবগঠিত আসামের সাথে জুড়ে দেয়। একটি অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘকালের স্বকীয় পরিচিতির তোয়াক্কা না করে তাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় অন্য অঞ্চলের ভাষা আর সংস্কৃতির ধারক হবার বোঝা।
১৯৪৭ সালের গণভোট শ্রীহট্ট জেলার ওপরে আবার আঘাত আসে। গণভোটে বরাক উপত্যকা ভারতে থেকে যায়, বাকি চলে যায় পূর্ব পাকিস্তানে। দেশ ভাগের পরে মূলত হিন্দু উদ্বাস্তুর ঢল নামে  পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাথে আসামেও। আসাম প্রশাসন প্রমাদ গোনে। তাদের জমি ও জীবিকার ওপরে চাপ সৃষ্টি হওয়া তে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ভয় তাদের কে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগায়। এর ফলে, প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় অসমিয়া ভাষা কে সঙ্খ্যাগুরুর ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এর ফল স্বরূপ, ১৯৪৮ সাল থেকেই আসামে শুরু হয় জাতিদাঙ্গা। ১৯৫৫ সালে এই দাঙ্গা চরমে পোঁছয়। ১৯৬০ সালে ঘোষণা করা হয় যে আসাম রাজ্যের ভাষা হবে শুধুই অহমিয়া। এতে ক্ষোভে ফেটে পরে বরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা। এর প্রতিবাদে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক ১৯ এর ভাষা আন্দোলন। বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ওপরে অহমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ‘কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ’ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। ১৯ মে, শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি তে হরতাল ও পিকেটিং শুরু হয় ।
একটা  রাজ্য সরকার, তার রাজ্যের অন্য ভাষাগোষ্ঠীর ওপর তার পছন্দের ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার প্রতিবাদে বরাক উপত্যকার বাঙালিরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। এই প্রতিবাদ দমন করতে রাজ্য পুলিশ রাজ্য প্রশাসনের অনুমোদনে গুলি চালালে ১১ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন। প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্যও এই বরাক আন্দোলনেরই ফসল। এই ঘটনার পর অসম সরকার, বরাক উপত্যকায়, বাংলা ভাষা কে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হন।  
এতো গেলো তথ্য আর সংখ্যা নিয়ে কচকচানি। কিন্তু এই তথ্যে পরিপূর্ণ নিবন্ধে আবেগ এর জায়গা কোথায়? যে আবেগের তোড়ে খড়কুটোর মত ভেসে গেছিলো সমস্ত নৃশংসতা, সমস্ত প্রতিরোধ। পৃথিবীর বুকে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা তাদের ভাষার সন্মান রক্ষার তাগিদে আমরা রক্ত ঝরিয়েছি । যে ভাষা এত আকুল করেছে বাঙালি জাতি কে, যে ভাষার জন্যে জল মাটির শরীর থেকে গর্বিত লাল রক্ত ঝরেছে, যে ভাষা আমার, তোমার চেতনা কে সজীব করে রেখেছে, সেই ভাষার প্রতি আবেগ, ভালবাসা আজ এত তলানিতে কেন? যে ভাষা কে জীবিত রাখতে, যার সন্মান তুলে ধরতে আমরা রক্ত দিয়ে তাকে সিঞ্চন করেছি, সেই মুখের ভাষা কে আমি, তুমি, চলো, বুকের ভাষা করি। আগামী প্রজন্মের সামনে আমাদের ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস কে তুলে ধরি, চলো ।

উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি

~ কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

বুকের রক্ত মুখে তুলে যারা মরে
ওপারে ঢাকায় এপারের শিলচরে
তারা ভালবাসা-বাংলাভাষার জুড়ি
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারী

সিঁদুর কুড়িয়ে নেওয়া যায় এক আলো
প্রাণের পুণ্যে হয়ে ওঠে জমকাল
সে আলোয় দেয় মারের সাগর পাড়ি
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারী

সে-আলো টলেনা মৃত্যুর কালো ঝড়ে
তর্জনী তুলে জেগে থাকে ঘরে ঘরে
দুলিয়ে গলায় তাজা বুলেটের মালা
পার হয়ে শত শ্মশান ও কারবালা
হাজার মুখের মিছিলে দিয়েছে পারি
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারী।  

তথ্য সৌজন্য – গুগল।

No comments:

Post a Comment

Till Death Do Us Part

The faint glow of the setting sun glistened on the ripples of the Jhelum, as the ripples moves away one by one. The wind coming from the ...