কে যেন একবার স্কটল্যান্ড নিয়ে বড্ড দুঃখ করে বলেছিল, ওই
টুকু একটা দেশ, ঠাণ্ডা তে রক্ত হিম হয়ে যায়, ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে, জঘন্য আবহাওয়া
কিন্তু, প্রকৃতি যেন সেই খেদ মেটাতেই, অকৃপণ ভাবে পিপে ভরে ভরে, সেরার সেরা সুধা
রেখে দিয়েছেন ওই স্কচগুলোর ভাঁড়ারে থুড়ি সেলার এ। তবে কিনা শুধু স্কচ রা নয়, এক
ফালি সমুদ্র ডিঙলেই আইরিশ রাও হুইস্কি তৈরি তে ওস্তাদ। এই স্কচ আর আইরিশ রা যখন
সপ্তদশ শতকে সাগর পেরিয়ে পা রাখল আমেরিকা মহাদেশের ভূখণ্ডে, তখন বাছাধনেরা পড়ল মহা
ফাঁপরে। তারা পান করে কি? এখানে তো তাদের দেশের মত বার্লির চাষ হয়না, আর না পাওয়া
যায় পিট।
পাঠক কুল যদি অনুমতি করেন তাহলে মূল গতিপথ থেকে একটু
ভিন্নমুখী হবো। তার কারণ হুইস্কিপুরাণ কথা অমৃতসমান, আর পুরাণের কথা বলতে গেলে আদি
পর্ব থেকে শুরু করতেই হয়। এখন প্রশ্ন হোল যে এই পিট বস্তুটি কি, এবং হুইস্কি তৈরি
পদ্ধতিতে এটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? পিট, আদ্র স্থানে বেড়ে ওঠা গাছপালা, গুল্মলতা,
শ্যাওলার আংশিক পচন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন কয়লার প্রাথমিক পর্যায়। শুষ্ক অবস্থায় এটি
অবাধে জ্বলে। এই পিটের ধোঁয়া তে শুকানো হয় আধা অঙ্কুরিত বার্লি। এই ধোঁয়ার আলগা
গন্ধ হুইস্কি তে লেগে থাকে। এই হুইস্কি সব নিজ নিজ বিশিষ্ট স্বাদে স্বমহিমায়
বিরাজমান। এবার তাহলে বোঝা গেল যে স্কচ এবং আইরিশ রা বার্লি এবং পিট না পেয়ে কি
পরিমাণ আতান্তরে পরেছিল। এর পরে ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ এর মতন, আমেরিকা
ভূখণ্ডের আবহাওয়া এবং জল, স্বাদ-গন্ধ সমস্ত আলাদা। কিন্তু এই হুইস্কি রসে যে
মজেছে, তার পক্ষে, এর থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা বড়ই কঠিন। ইংরেজি তে একটা কথা আছে
না, ‘Necessity is the mother of all inventions’ অর্থাৎ, প্রয়োজন
পড়লে ঠিকই রাস্তা বেরোয়। মাথা টাথা চুলকিয়ে আশপাশ টা পর্যবেক্ষণ করে তারা দেখল যে
আমেরিকান নেটিভ রা জব, বার্লির চাষ না জানলেও, ভুট্টার চাষ করে প্রচুর পরিমাণে। তাই অগত্যা
ভুট্টা দিয়েই হুইস্কি তৈরির চেষ্টা করা হোল, এবং কি আশ্চর্য, তৈরি হল আর এক বিশ্বজয়ী
পানীয়। এটিও হুইস্কি বটে, কিন্তু এর স্বভাবচরিত্রও, সাকিন সবই আমেরিকান। নাম দেওয়া
হল বুরব্যঁ। আজকের জ্যাক ড্যানিয়ালস, জিম বিম, এই বুরব্যঁর মুকুটের এক একটি পালক। এ
তো গেল সাহেবদের ভিন দেশে নিজেদের দেশীয় রসদের জোগারযন্ত্রের গপ্প ।
ইতিমধ্যে, দলে দলে বঙ্গপুঙ্গবেরা, মার্কিন মুলুকের immigration
এর কঠোর নিয়মের ফাঁক গলে, স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ এর
হাতছানির ডাকে সাড়া দিয়ে সুড়ুত করে ঢুকে পড়েছে, the land of great opportunities এ।
কিন্তু প্রশ্ন হল, যে তারা কি ওখানে পৌঁছে তাদের দেশের শুক্তো, ছ্যাঁচড়া, লাউ
ঘণ্ট, কোপ্তা, কালিয়া, ইলিশ, পাঁঠার মাংসও, চিংড়ির মালাইকারি, পোলাও, দই মিষ্টি কে
একেবারে, ভুলে মেরে দিলো? তাই কি কখন সম্ভব? আর ঠিক স্কচ আর আইরিশ দের মতই, আমাদের
‘Made in India’ সাহেব সুবো রা,
সেই মার্কিন দেশের সহজে লভ্য রসদ, যেমন, যুকিনি আর আর্টিচোক কে কি, শুক্তুনি তে
ব্যবহার করতে শুরু করলো? অথবা, খিচুরি তে কি তারা ব্রকোলি দেয়? রবিবারে কি পাঁঠার
বদলে টার্কির ঝোল খায়? আমেরিকা এবং আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে গত পঞ্চাশ
বছরে যত লেখালেখি হয়েছে, ততটা বোধহয় আপন বঙ্গভূমি নিয়েও হয়নি। তবু যতই বই পড়ি না
কেন, কিছু কিছু জিনিষ আছে যেগুলো, ওখানে গিয়ে না পড়লে, নিজের চোখে না দেখলে, নিজের
জিভে আস্বাদ না নিলে, বোঝা দায়।
এক পরিচিতর কাছে শুনলাম, সানফ্রান্সিস্কো তে তার মেটে চচ্চড়ি খেতে ইচ্ছে হওয়া তে, তিনি,
ফ্রাঙ্কফুর্টার সসেজ কে টুকরো টুকরো করে কেটে চচ্চড়ি করেছিলেন কারণ অনেক খুঁজেও
পাঁঠার মেটে পাননি। ফ্রাঙ্কফুর্টার সসেজ অতি উত্তম এক খাদ্যবস্তু, কিন্তু তার
নিজস্ব স্বাদ গন্ধ আছে, এবং সেই স্বাদ গন্ধ, একেবারেই পাঁঠার মেটের স্বাদ গন্ধের
ধার কাছ দিয়েও যায়না। তার পর জিরে ধনে গরম মশলার গন্ধও, সসেজ এর গন্ধের সঙ্গে
তেল-জলের মত মারামারি করতে পারে, তাই, তিনি সেগুলোও বাদ গেলো। তার বদলে, তার মধ্যে
পড়ল, লাল ওয়াইনের থেকে তৈরি ভিনিগার, দু চামচ, গোলমরিচ, বেশি করে লাল লঙ্কা, আদা
আর রসুন। পড়ল, টমেটো আর কিছু মেথি পাতা। সসেজ গুলো টুকরো করে কেটে হাল্কা ভেজে
নেওয়া হল, সর্ষের তেল এর বদলে সাদা তেলে, পড়ল, কিঞ্চিত মাখন। ফলে যে বস্তু টি
প্রস্তুত হল, সেটি অতীব উপাদেয়ও, অথচ দেখুন, সসেজ আর লাল ওয়াইন বাদে বাকি
জিনিষগুলো কিন্তু ষোল আনা দিশি। এখানেও সেই ফিউশন এর জয়জয়কার।
আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যে হিউস্টন শহরটি যেমন নাসা র জনসন
স্পেস সেন্টার এর জন্যে বিখ্যাত, তেমনি সে খ্যাত, আমেরিকার সব শহর গুলির মধ্যে
সবচেয়ে বেশি বাঙালি অধ্যুষিত বলে। গুজরাতি দের স্বামী নারায়ণ মন্দির আমেরিকার বেশ
কয়েকটি শহরে দেখা গেলেও, বাঙালিদের দুর্গা বাড়ি কিন্তু একমাত্র এই হিউস্টন শহরকেই
আলোকিত করে আছে। এই শহরে আমার ভাই এর বাড়ি থাকার সুবাদে এই শহরের
আমেরিকান-বাঙ্গালিয়ানার ফিউশনের সত্তা টা কে অল্প হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছি। রাতে
কষা মুরগির মাংসের সাথে গরম গরম মুচমুচে বাদামি পরটা খেয়েছি। এই পরটা গুলো
কিন্তু মালয়েশিয়ান দোকান থেকে কেনা, একটা প্যাকেট এ গোটা দশেক কাঁচা পরটা পাওয়া যায়,
তাওয়া তে একটু উলটে পালটে নিলেই হল।
আভোকাডো খেয়েছিলাম প্রথম বার একটি রেস্তরাঁ তে, নাম রাগলস।
অখাদ্য লেগেছিল মেক্সিকো থেকে আগত, ফল আর সবজির মাঝামাঝি বস্তুটি কে। এটিকে
দেখতে কাঁচা আম আর কিছুটা গন্ধরাজ লেবুর মাঝামাঝি একটা ফলের মত, মাঝে একটা বড়সড় বীজ, যার
চারপাশে নরম শাস, যার স্বাদ বলতে না টক, না মিষ্টি, না ঝাল, বাংলা কথায় পানসে একটা
স্বাদ কিন্তু পুরো আমেরিকা তে এটি কে নিয়ে খুব মাতামাতি। আমার পাশে বসে, আমার ভাই
দেখলাম পরম তৃপ্তির সাথে ওই আভোকাডো স্যালাড, যার মধ্যে আর নানান ধরনের ঘাস পাতাও
রয়েছে, গলঃধরন করছে। পরে অনেক ধৈর্য সহকারে আমাকে বোঝাল যে প্রথম প্রথম ওই দেশে
গিয়ে ওরও ওই প্লেট ভর্তি ঘাস পাতা দেখলেই নাকি মনে হত যে আশেপাশে ঝোপঝাড় থেকে কেউ
ছিঁড়ে ওর প্লেট ভর্তি করেছে, পরে পরে ওর নাকি, এটাতেই অভ্যাস হয়ে যায়, এবং এরও
পরে ওর এসব ভালো লাগতে শুরু করে। এই ব্যাপারটা কে নাকি বলে acquired taste, এবং আমি কিছুদিন থাকলে নাকি আমারও ভালো লাগতে শুরু
করবে। মিথ্যে বলব না, পরে পরে এই আভোকাডো র পুর দিয়ে পরটা খেতে মন্দ লাগেনি। এই রাগলসেই কিন্তু খেয়েছিলাম 'টমেটো - বেসিল' সুপ। যে দুটো উপকরণ দিয়ে পদ টি বানানো, মানে, টমেটো এবং তুলসী পাতা, এই দুটোই আমাদের দেশে খুবই সহজে পাওয়া যায়, বরং তুলসী ওই দেশেই বেশ দুষ্প্রাপ্য, exotic herbs, বলে বিদিকিচ্ছিরি একটা দাম নিয়েছিল ওই সুপটার, কিন্তু খেতে বেশ লেগেছিল আমার। বুঝলাম, যে তুলসী নিজের কৌলীন্য বজায় রেখেছে সর্বত্র, কোথাও নারায়ণ রূপে তো কোথাও আবার ভিন্নদেশীয় উদ্ভিদ হিসেবে।
ভারতবর্ষের খাদ্য পানীয়র যদি কোন ইতিহাস রচনা হয়, তাহলে সেখানে সুরা অথবা কারন বারির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থাকবেই। অথচ, পশ্চিমের ওয়াইন এখানে কোনদিন জায়গা করে নিতে পারেনি। হালে, নাসিক এ ওয়াইন শিল্পের কিছুটা বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, কিন্তু ওয়াইনটা মেয়েদের পানীয় হিসেবেই এদেশে চিহ্নিত। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার নাপা উপত্যকায় গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো, শুধু স্থানটির সৌন্দর্যেই নয় । হাঁ হয়ে দেখতে থাকলাম যে, ব্যবসা করতে গিয়েও, তাতে একটা আলাদা শৈল্পিক মাত্রাকে কি ভাবে এরা বজায় রাখতে পারে। এখানে যেমন ওয়াইন ট্যুর নেওয়া যায়, ওয়াইন ট্রেনে করে, যেমন হরেক রকম ওয়াইন এর স্বাদ নেওয়া যায়, বিভিন্ন ওয়াইনারি তে বসে, তেমনি, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার আনুকূল্যে এখানে বেড়ে ওঠা মাইল এর পর মাইল আঙ্গুরের ক্ষেত চোখে শান্তির প্রলেপ আঁকে।
বিশ্বখ্যাত এই ওয়াইনারি গুলো, যেমন রবার্ট মন্ডাভি, ভি সাত্তুই তে, যেমন 'শারডনে', 'পিনো নাওয়ার', 'মালবেক', 'ক্যাবুর্নে সোভীন্য' ওয়াইন সব থরে থরে সাজানো থাকে, তেমনি, নানান রকম চীজ, ফল, হরেক রকম ব্রেড, আচার, অলিভ অয়েল এর সম্ভার ও জিভে জল আনে। এখানেই প্রথম ওয়াইন, চীজ আর আঙুর সহযোগে খেয়েছিলাম। সেই স্বাদ আজ ও ভুলিনি।
বিশ্বখ্যাত এই ওয়াইনারি গুলো, যেমন রবার্ট মন্ডাভি, ভি সাত্তুই তে, যেমন 'শারডনে', 'পিনো নাওয়ার', 'মালবেক', 'ক্যাবুর্নে সোভীন্য' ওয়াইন সব থরে থরে সাজানো থাকে, তেমনি, নানান রকম চীজ, ফল, হরেক রকম ব্রেড, আচার, অলিভ অয়েল এর সম্ভার ও জিভে জল আনে। এখানেই প্রথম ওয়াইন, চীজ আর আঙুর সহযোগে খেয়েছিলাম। সেই স্বাদ আজ ও ভুলিনি।
টেক্সাস চিলড্রেন'স হাসপাতালে শিশু চিকিৎসক আমার ভাই এর স্ত্রী। সেই হাসপাতালের ব্যাপ্তি এবং, অসুস্থ শিশুদের নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা, শুধু শরীর ঠিক করা নিয়েই না, শিশুদের মনের খিদে মেটানোর জন্যেও, কত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েও তাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই গপ্প অন্য একদিন, আজ, এখানে বলব, সেই হাসপাতালের দুটি বৃহৎ আকারের ক্যাফেটেরিয়ার একটি তে দুপুরের ভোজনপর্বের কথা। ক্যাফেটেরিয়ার দুটো দিকে নানান দেশীয় খাবার সাজানো। প্লেট এ তুলে নিলাম মেক্সিকান 'বুড়িতো', একেবারেই দিশি খাবার যেন, রুটি, ভাত, সবজি, স্যালাড, ডাল, মাংস। এর মধ্যে আবার, ডাল, সবজি, মাংস, দুই - তিন রকমের আছে, নিজের নিজের পছন্দ মত নিয়ে নিন আর সবটা রুটি তে রোল করে মুখে পুরে ফেলুন। পেট পুরে যেন বাড়ির খাবার খেলাম। দেখলাম এক জায়গায় ছোট্ ছোট মিনিয়েচার গোটা বাঁধাকপি সেদ্ধ করে রেখেছে, ওপরে কি সব মসলা ছড়ানো। নাম শুনলাম, 'ব্রাসেল স্প্রাউট', খেয়ে দেখলাম, খুবই সুস্বাদু, অবিকল বাঁধাকপির মত খেতে, যদিও বেলজিয়ামের সাথে এই সবজিটির যোগাযোগ আদৌ আছে কিনা, জানা হয়ে ওঠেনি।
টেক্সাস যেহেতু, মেক্সিকো লাগোয়া, এখানে 'টেক্স - মেক্স' খাবারের চল খুব বেশি। টেক্সাস এর রাজধানী শহর অস্টিন এ একটি 'টেক্স - মেক্স' রেস্তরাঁ 'চুপা কাব্রা' তে খেয়েছিলাম 'বীফ - এনকিলাডা ' দারুণ খেতে, অনেকটা মাটন ভর্তার মতন।
টেক্সাস যেহেতু, মেক্সিকো লাগোয়া, এখানে 'টেক্স - মেক্স' খাবারের চল খুব বেশি। টেক্সাস এর রাজধানী শহর অস্টিন এ একটি 'টেক্স - মেক্স' রেস্তরাঁ 'চুপা কাব্রা' তে খেয়েছিলাম 'বীফ - এনকিলাডা ' দারুণ খেতে, অনেকটা মাটন ভর্তার মতন।
বীফ এনকিলাদা |
টেক্সাস এর আর একটি শহর, 'সান আন্টনিও' তে আরেকটি মজার ঘটনা মনে পরে। এই শহরটি একদা মেক্সিকোতেই ছিল কিন্তু ১৮৩৬ সালে, 'ব্যাটল অফ সান জাসিণ্টো' তে, টেক্সানরা, মেক্সিকান জেনারেল লোপেজ ডে সান্টা আনার বাহিনী কে পরাস্ত করে, সেখানের দুর্গ, ' আলামো মিশন' দখল করে। রোমহর্ষক সেই যুদ্ধের গল্প ছাপানো, হোটেলের ব্রোশারে। ঝটপট মুখ হাত ধুয়ে নিয়ে হোটেল এর পাশে ' whataburger' এ একটা চিকেন বার্গার গলঃধরন করে রাস্তায় বেরিয়ে পরলাম এই বিখ্যাত আলামো দুর্গ দেখতে। ভারতবর্ষের রাজস্তান, হায়দ্রাবাদের গোলকন্ডা, বিজাপুর দুর্গ, চোখের সামনে ভাসতে লাগল। রাস্তায় মানুষজন কে আলামো জিজ্ঞেস করতেই হাসি মুখে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা পাথরে বাঁধানো চত্বরে এসে দাঁড়ালাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে, কিছুই ঠাওর করতে না পেরে, একজন কে জিজ্ঞেস করতেই অবাক হয়ে সামনে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। চোখে মুখে ভৎর্সনার ভাব তার, চোখ সরু করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, এত বড় দুর্গ আমরা দেখতে পাচ্ছি না বলে । ভয় পেয়ে গেলাম, নিজের দৃষ্টিশক্তি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠলাম। পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল পাথরের একটা ১২-১৪ ফুটের দেওয়াল, তার সামনে একটা বড় সড় কাঠের দরজা, লোহার চাকতি বসানো, তার সামনে লোহার শিকলের রেলিং, দেওয়ালের পিছনে, একটা
বিস্তেক ত্যাকো |
গ্রিল্ড হালাপেনো উইথ আভোকাডো অ্যান্ড সালসা |
হিউস্টন দুর্গা বাড়ি তে চার দিনের দুর্গাপূজা তে খুব জাঁকজমক। আমেরিকার দূরদূরান্ত থেকে বাঙালি রা তাদের নিজস্ব brand এর বাঙ্গালিয়ানা নিয়ে হাজির। এমনকি কানাডা থেকেও বাঙালি রা এসেছেন গাড়ি চালিয়ে। হই হই রই রই কাণ্ড। পূজা চলছে বিশাল অডিটোরিয়াম এর ভেতরে। একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর ব্যবস্থা, কলকাতা থেকে, অনেক দাম দিয়ে শিল্পীদের, নিয়ে আসা হয়েছে। আর এক দিকে দেখলাম কিছু উদ্যোগী বঙ্গ সন্তান, নানান বাঙালি পশরা সাজিয়ে বসেছেন। তাতে, বেলুন চাকি, বেতের ঝুড়ি ও যেমন দেখতে পেলাম, তেমনি পেলাম নানান কিসমের শাড়ি, পাজামা, পাঞ্জাবি, আর গড়িয়াহাট, দক্ষিনাপণ এর দোকানে পাওয়া যায় এমন নানান ইমিটেশন, ডোকরার, পাথরের গয়নার সম্ভার। টপাটপ বিক্রিও হচ্ছে সেসব। অন্য দিকে শাঁখা-পলা, আলতা, সিঁদুর, জামদানি, কাতান পরা আমেরিকো-বঙ্গললনা রা আর ছোট ছোট বাচ্চা রা ছোটাছুটি করছে। আমার প্যাঁচালো মনে একটা প্রশ্ন জাগলো, যদি, এই প্রেক্ষাপট বদলে, এই ললনারাই একডালিয়া, দেশপ্রিয় পার্ক এর মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতো, তাহলে কি এমন রাঙ্গা আলতা পরা পা দেখতে পেতাম, নাকি চওড়া সিন্দূর পরা মাথা দেখে মুগ্ধ হতাম? তাহলে কি, নিজের নিজের শিকড়ের খোঁজ পেতে বাঙালি দের আমেরিকা কি নিদেন পক্ষে বিলেতে পারি দেওয়া উচিত?
আমার চিন্তায়, ছেদ পড়ল, লুচি ছোলার ডালের ঘ্রাণে। বিশাল তাবু, তার ভিতরে খাওয়ার আয়োজন। এক মহাযজ্ঞ যেন। এক এক বারে, প্রায় ২৫০ জনের পাত পড়ছে। একদম সাবেকি বাঙালি ভোজ। অষ্টমী তে লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম, চাটনি, পায়েস। এর পর এলো নরম পাকের ছানার সন্দেশ, কিন্তু সেই সন্দেশের, স্বাদ-গন্ধ আমাদের ভীম নাগ অথবা বলরাম মল্লিক এর থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। পাশে বসা ঘরোয়া বাঙালি মতে শাড়ী পরা, কানে ঝুমকো, হাস্যময়ী সুন্দরী কে খটকার কথা বলতেই, তিনি আমার ভুলটা ধরিয়ে দিলেন। এটা তো আদৌ ছানার সন্দেশ ই না। আমেরিকা তে খুব ই কম সংখ্যক দুষ্প্রাপ্য জিনিষের মধ্যে একটা হল ছানা। কিন্তু বাঙালি রা ছানার সন্দেশ না খেয়ে বাঁচে কি করে? এই ডেসার্ট টি তো আমাদের বাঙালি দের জাতীয় দুর্বলতার পর্যায়ে পরে। ফলেই আবার মাথা খাটানোর পালা, এবং ফলাফল হল আমেরিকান বাঙালি দের ঘরে ঘরে রিকোটা চীজ দিয়ে তৈরি সন্দেশ। এই চীজ এর সাথে কনডেন্সড দুধ মিশিয়ে চিনি দিয়ে বেক করলে এই রসনা মোহিত করা মিষ্টান্ন টি প্রস্তুত হয়। বৈচিত্র্য আনার জন্য, এই মিশ্রন টি তে কেশর অথবা চকলেট পাওডার অথবা তরল চকলেট মেশালেই মনপসন্দ কেশর সন্দেশ অথবা চকলেট সন্দেশ।
আমেরিকান বাঙালি দের ঘরে ঘরে মিষ্টি বানানোর খুব চল আছে। এছাড়াও চল আছে কড়াইশুটির কচুরি, মোগলাই পরটা, চপ বানানোর। মনে করিয়ে দেয় আমাদের ঠাকুমা দিদিমাদের আমলের কথা, যখন ফাস্টফুড বাড়িতেই তৈরি হত। এই ফুডগুলি যথেষ্ট ফাস্ট তৈরি না হলেও স্বাদে অতুলনীয় ছিল। তৈরি খাবার, প্রস্তুত করা জলখাবার, বাইরে পাওয়া না যাবার ফলেই এই দুই দেশে, দুই কালে, একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে বাঙালি। কারন চিরকাল রসেবশে থাকা বাঙালির জিনে ভোজন রস ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে, এর থেকে পালানোর পথ নেই। হিউস্টনে এক বন্ধুর বাড়িতে, ঘরে পাতা মিষ্টি দই খেয়ে মনে পরে গেলো, অনেক বছর আগে ঢাকা শহরে বেড়াতে গিয়ে প্রসিদ্ধ মরনচাঁদের দই এর স্বাদ। আশ্চর্য মিল স্বাদে। রেসিপি জিজ্ঞেস করতেই তৎক্ষণাৎ হাসি মুখে বলে দিয়েছিল। দু কাপ দুধ ফুটিয়ে ঘন করে, তাতে এক টিন কনডেন্সড দুধ আর গ্রীক ইয়গার্ট মিশিয়ে, ৩৫০ ডিগ্রি তে আধঘণ্টা খানেক বেক করতে হবে। ব্যাস, দই প্রস্তুত।আমেরিকান ইস্ট-কোস্টে যে বাঙালি রা থাকেন, বিশেষত নিউ জার্সির দিকে, তারা বলেন, কলকাতায় যাবতীয় যা পাওয়া যায়, সেই সব কিছুই নাকি নিউ জার্সি তে পাওয়া যায়, আত্মীয় স্বজন বাদে। অর্থাৎ কিনা, মা বাবা, বাকি আত্মীয় স্বজন দের নিউ জার্সি তে আমদানি করতে পারলে সেখানে একটা মিনি কলকাতা বানিয়ে ফেলতে পারবে। এমনি এক নিউ জার্সি স্থিত বাঙ্গালিনি গরবিনীর বাড়িতে খেয়েছিলাম সর্ষে–ইলিশ থুড়ি, সর্ষে-স্যামন। স্যামন ফিলে, ঈষদুষ্ণ জলে লেবুর রস আর নুন দিয়ে ম্যারিনেট করতে হবে কয়েক ঘণ্টা। এরপর, ‘মকরমিক গুর্মে অল গ্রাউন্ড মাসটার্ড পাওডার’,(যার স্বাদ ঠিক সানরাইজ গুড়ো মশলার মত) কাঁচা লঙ্কা, সর্ষের তেল, নুন মাখিয়ে, ফিলে গুলোকে, ৩০ মিনিট কম আঁচে বেক করতে হবে। ভোয়ালা!! (আরে বাবা, কয়লা টয়লা নয়, ফ্রেঞ্চে, 'ভোয়ালা' মানে, কিম আশ্চর্যম!) কে বলে, যে সর্ষে ইলিশ তুল্য কোন মাছের পদ হয়না?
খানা-ফিউশন আর খাদ্য দ্রব্য ইম্প্রভাইজেশন নিয়ে যখন এতটাই বলে ফেললাম, তখন খাঁটি আমেরিকান দেশজ একটি ডেজার্ট এর কথা না বলে পারছিনা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, বঙ্গ-আমেরিকানরা ওখানকার কিছু খাবার কে পছন্দ করে আপন রান্নাঘরে আর মনে স্থান দিয়েছে।
ফ্রুট ট্রাইফেল |